প্রভাত  সঙ্গীত ও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি

লেখক
শ্রীজ্যোতির্ময় পাহাড়ী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

‘দেওঘরের’ আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে নিম্নের জ্যোতিগীতি দিয়ে প্রভাতসঙ্গীতের  শুভারম্ভ হল,

বন্ধু হে, নিয়ে চলো,

আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে৷৷

আঁধারের ব্যথা আর সয় না প্রাণে৷৷

ঘুমের ঘোর ভাঙ্গানোর গানে গানে৷৷ 

উপরোক্ত গান শুধুমাত্র ৫০১৮টি গানের বিশাল  সঙ্গীত ভাণ্ডারের শুভারম্ভ  নয়, এটি হল এই সঙ্গীত ভাণ্ডারের মুখবন্ধ৷ প্রভাত সঙ্গীত কেবলমাত্র সাময়িক  মনোরঞ্জনের জন্য সঙ্গীত মাত্র নয়, প্রভাতসঙ্গীতের আবেদন চিরন্তন, শাশ্বত৷ প্রভাতসঙ্গীতের মাঝে লক্ষ্য  করা যায় মিষ্টিকবাদের প্রতিফলন৷ মিষ্টিকবাদ হল অসীমের সঙ্গে সসীমের যোগসুত্র স্থাপনের এক গভীর প্রয়াস৷ মিষ্টিকবাদের এই আবেদন  যেমন প্রভাত সঙ্গীতকে চমৎকারিত্ব প্রদান করেছে তেমনি এই সঙ্গীতকে বিশ্বজনীনরূপ ও প্রদান করেছে৷ এই সঙ্গীতের মাধুর্য শিল্পী ও শ্রোতা উভয়ের মধ্যে  আধ্যাত্মিকতার ভাব সৃষ্টি করে এবং তার ফলে অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে তাদের উত্তরন হয়৷ সৃষ্টিকর্তা মানুষকে  সামাজিক জীব হিসাবে  পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছিলেন৷ তাই সে একা থাকতে ভালবাসে না৷ মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তু সকলে একে অপরের সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজে বাস করে সুখী হতে চায়৷ পিতামাতা, ভাইবোন, বন্ধু, আতমীয়-স্বজন সকলেরমাঝে আনন্দে দিন কাটাতে চায়৷ কিন্তু এই পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়৷ তাই  প্রকৃতির নিয়মে  একের সঙ্গে  অপরের বিচ্ছেদ হয়৷ আবার  স্বার্থের কারণে মানুষকে  চিরকাল বন্ধু হিসাবে পাশে পাওয়া যায় না৷ একমাত্র পরমপিতা ব্রহ্মই চিরস্থায়ী পরমবন্ধু হতে পারেন৷ জন্ম থেকে  মৃত্যু পর্যন্ত সুখে দুখে তিনি সঙ্গে থাকেন৷ তাঁকে  মনপ্রাণ দিয়ে ভাল বাসলে তিনি মনের যাবতীয়  অন্ধকার  দূর করে মনের মধ্যে আলোর ঝর্ণাধারা বইয়ে দেন এবং  মরনের  পরেও কোলে স্থান দেন৷  আধ্যাত্মিক ভাব সমৃদ্ধ প্রভাত সঙ্গীতের এই প্রথম গানে প্রিয়বন্ধু পরমব্রহ্মকে প্রার্থনা ও অন্তরের আকুতি  জানান হয়েছে৷ তাছাড়া এই পৃথিবীতে মানুষের  শোষন, বঞ্চনা, নিপীড়নের  মত সর্বগ্রাসী অন্ধকার  পরিবেশ থেকে এবং ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষের শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের মত সর্বগ্রাসী অন্ধকার পরিবেশ থেকে ওমানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে  পদার্পণের  আকাঙ্খা পরিহার  করে সত্য, ন্যায়   ও ধর্মীয় আলোকজ্জল জীবনের দিকে ছুটে চলার  আবেদন প্রভাত সঙ্গীতের প্রথম গানের  মূল বিষয়৷

আনন্দমার্গ দর্শন বলে আদি, অনন্ত ও আনন্দময় ব্রহ্মই একমাত্র উপাস্য, মানবসমাজে  জাত-পাত ও সম্প্রদায়গত কোন বিভেদ থাকবে না৷ এবং সকল মানুষের একধর্ম, সেই ধর্ম হল মানবধর্ম, যার অপর নাম ভাগবতধর্ম৷ এই দর্শন বলে যে, অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ  নিজেকে মুক্তিপথের সন্ধানে এগিয়ে নিয়ে চলবে এবং সর্বাঙ্গীন মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে সেবা, ত্যাগ ও জনকল্যাণের দ্বারা সমাজের সার্বিক উন্নতি  ও সকলপ্রকার শোষন মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাবে৷ আগুনের যেমন ধর্ম এক, জলের যেমন ধর্ম এক তেমনই সকল মানুষের ও ধর্ম এক ও তা হল ভাগবত ধর্ম৷ মানুষের অনেক ধর্ম হতে পারে না৷  রেলিজান religion) বা ধর্মমত বা উপধর্মের  সংখ্যা অনেক হতে পারে৷ রেলিজান religion) বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ভিত্তিক আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি৷ এই  বিভেদমূলক রেলিজনকে  নয়,যথার্থ ভাগবতধর্মকে  আনন্দমার্গ অনুসরণ করে ও উৎসাহ দেয়, এই ভাগবতধর্মের মূলকথা কেবল অন্যান্য প্রাণীর মত খেয়ে ঘুমিয়ে জীবন না কাটিয়ে মানুষের জীবনের চরম আত্মবিকাশ সাধন করা এবং সেবার দ্বারা জগতের সকল জীবের কল্যান সাধন করা৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্বিধায় চ’’  অর্থাৎ একদিকে যেমন মানুষের  মনের চরম আত্মবিকাশ ঘটিয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যেতে হবে, অন্যদিকে জগতের কল্যানের জন্য  মানুষকে সকল জীবের সেবা করে যেতে হবে৷ ইহাই হল মানুষের ভাগবতধর্ম৷ এই ভাগবত ধর্ম পালন করাই মানুষের জীবন সাধনা৷ এটাই মানবধর্মের  মূলকথা৷ প্রভাতসঙ্গীতের  গানে গানে এই মানবধর্মের  কথা সুন্দরভাবে বলা হয়েছে৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নব্যমানবতাবাদ তত্ত্ব এক অভিনব বিষয় যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল৷ তাঁর রচিত প্রভাতসঙ্গীতের ভাষায়  নব্যমানবতা- বাদ হল---

‘‘মানুষ যেন মানুষের

               তরে সব কিছু করে যায়,

একথাও যেন মনে রাখে

               পশুপাখী তার পর নয়

তরু ও বাঁচিতে চায়৷’’

--- এই নব্যমানবতাবদই  তাঁর শিক্ষা সংসৃকতি তথা  সমগ্র  সমাজ- দর্শনের  অন্যতম  প্রধান ভিত্তি৷ 

(ক্রমশঃ)