প্রভাত সঙ্গীত প্রসঙ্গে

লেখক
আচার্য নারায়ণানন্দ অবধূত

সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল সঙ্গীত৷ নিম্নমানের সঙ্গীত যেমন মানুষের অন্তর্নিহিত পশুভাবকে জাগিয়ে তোলে তেমনি উচ্চমানের সঙ্গীত মানুষের ভিতরে সুপ্ত দেবভাবকে জাগিয়ে তোলে৷ বর্তমান সমাজের সর্বাত্মক অবক্ষয় থেকে সঙ্গীত জগৎও রেহাই পায়নি৷ এই অবক্ষয়কে রোধ করে সংস্কৃতির আঙ্গিনায় নূতন প্রভাতের আবির্ভাব হ’ল শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তথা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত ‘প্রভাত সঙ্গীত’৷ মোট ৫০১৮টি প্রভাত-সঙ্গীত রচনা ও সুর তাঁরই সৃষ্টি৷

গানের স্তম্ভ হচ্ছে চারটি---ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দ৷ এর মধ্যে ভাষার আবেদন সীমিত হলেও ভাব, ছন্দ ও সুরের আবেদন সর্বজনীন৷ প্রভাত সঙ্গীত আটটি ভাষায় -বাংলা,হিন্দী,সংসৃকত, অঙ্গিকা, উর্দু, মৈথিলী ও মগহী ভাষায়  রচনা করেন৷ প্রভাত সঙ্গীতের অধিকাংশ গানগুলির মধ্যে মিষ্টিকবাদের ধবনি অনুরণিত হয়েছে৷ মিষ্টিকবাদ কী? অসীমের সঙ্গে সসীমের সম্বন্ধ নির্ণয়ের যে সীমাহীন প্রয়াস তা-ই মিষ্টিকবাদ৷ আর এই কারণেই প্রভাত সঙ্গীতের গানগুলি এতই মাধুর্যমণ্ডিত হয়েছে যে সেগুলি ভারতের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব সংস্কৃতির বিশাল অঙ্গনে স্থান করে নিতে পেরেছে৷ তবে প্রভাত-সঙ্গীতের ভিত মিষ্টিকবাদ হলেও মানব জীবনের অপরাপর দিকের ভাবনাও এতে স্থান পেয়েছে৷ তাই দর্শন চিন্তা ও অধ্যাত্ম চিন্তা থেকে শুরু করে সমাজ চেতনা, আশাবাদ, নব্যমানবতাবাদ, নিসর্গ, প্রকৃতি, স্বপ্ণ, সামাজিক অনুষ্ঠান, ভক্তিগীতি, ভাব সঙ্গীত, ঋতু পর্যায়ের, গণসঙ্গীত, দেশপ্রেম, ঝুমুর, বাউল, কীর্ত্তন ও ভাঙা  কীর্ত্তন, গজল ও ভাঙা গজল, কাওয়ালি, শিবগীতি, কৃষ্ণবিষয়ক, রূপকথা ও জীবনীমূলক গানও এতে স্থান পেয়েছে৷ প্রভাত সঙ্গীতের মধ্যে ভাষার যে বলিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা, ভাবের যে গভীরতা, ছন্দের যে বৈচিত্র্য ও সুরের যে হৃদয়স্পর্শিতা প্রকাশ পেয়েছে তা গানের জগতে অদ্বিতীয়৷

আজ ভোগবাদ বা জড়বাদ সর্বস্ব অপসংস্কৃতির মত্ত দানব তার নাগপাশ বিস্তার করে সমগ্র মানব সংস্কৃতির পরিবেশকে অসুস্থ ও অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে৷ এর ফলে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে, মানুষ হীনবল হয়ে পড়ছে৷ অপসংস্কৃতির এই বিষাক্ত পরিবেশের বিরুদ্ধে সমাজ সচেতন সকল মানুষকেই সরব ও গর্জে উঠতে হবে৷ শুধু নিন্দা করে এর গতিরোধ করা যাবে না৷ উচ্চ ভাবধারার স্পর্শে মানুষের মনের কালিমাকে দূর করতে হবে৷ জ্যোতির্ময় পুরুষের আলোয় মনের অন্ধকারকে সরিয়ে তা আলোয় ভরে দিতে হবে৷

দর্শনের জগতে আনন্দমার্গ দর্শন, অধ্যাত্ম সাধনার জগতে আনন্দমার্গের সাধনাপদ্ধতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক জগতে ‘প্রাউট’ দর্শন, সামাজিক-বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে ‘নব্যমানবতাবাদ’ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যেমন অসাধারণ সৃষ্টি, সঙ্গীতের জগতে তেমনি ‘‘প্রভাত সঙ্গীত’’ তাঁরই আরেক অতুলনীয় অবদান৷ প্রভাত সঙ্গীতের যে সর্বস্পর্শী আবেদন তা কারোর পক্ষে  উপেক্ষা করা সহজ হবে না৷ জীবনে মরণে, ব্যথা-বেদনায়, হাসি-কান্নায়, সুখে- দুঃখে-হতাশায় এই গান তাকে অফুরন্ত প্রেরণা জোগাতেই থাকবে৷

১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে প্রভাত সঙ্গীতের রচনা শুরু করেন আর ১৯৯০ সালে ২০শে অক্টোবর (মহাপ্রয়াণের পূর্ব দিন) রাত্রি সারে এগারটায় প্রভাত-সঙ্গীতের শেষ ৫০১৮ সংখ্যক গানটি রচনা করেন৷ গানটি ছিল প্রস্তাবিত আনন্দমার্গ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত৷