আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর দেওঘরে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে আমাদের পরমশ্রদ্ধেয় বাবা মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্র্ত্তিজ্ প্রভাত সঙ্গীত রচনা শুরু করেন৷ এর আগে কেউ জানতই না যে তিনি সঙ্গীতের সুর, লয়, তাল প্রভৃতি সম্পর্কে সব কিছুই জানেন৷ তিনি কারও কাছ থেকে এই সব শেখেননিও৷ কিন্তু হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি সঙ্গীত রচনা শুরু করে দিলেন৷ তাতে সুরও দিলেন তিনি নিজে৷ এই সুর দিয়ে আমাদের দিয়ে গান গাওয়ালেনও৷ বলা বাহুল্য, আমিও সেদিন ওখানেই ছিলুম৷ আমরা আমাদের পরমপ্রিয় বাবার রচিত সঙ্গীত তাঁর সুরেই সমবেত কণ্ঠে গাইছিলুম–
বন্ধু হে নিয়ে চলো, আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে৷৷
আঁধারের ব্যথা আর সয়না প্রাণে৷৷
ঘুমের ঘোর ভাঙানোর গানে গানে৷৷
আমাদের পরমপ্রিয় ‘বাবা’ এই গানটির নামকরণ করলেন ‘জ্যোতিগীতি’৷ এই গানটি স্মরণ করিয়ে দেয় উপনিষদের সেই শ্লোক ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়,
অসতো মা সদ্গময়
মৃত্যোর্মা মৃতম গময়ো
–মানুষের জীবনের চিরন্তন আকুতি আমাকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আলোকের পথে নিয়ে চল৷ আমার জড়তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমাকে চৈতন্যের জ্যোতির্লোকে নিয়ে চল৷
এরপর একে একে বাবা সঙ্গীত রচনা করতে থাকলেন৷ নিজে তাতে সুর বসিয়ে কয়েকজন দাদাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে অন্যান্য আনন্দমার্গীদেরও গাইতে উৎসাহিত করলেন৷
এই নতুন সঙ্গীতের নামকরণও হ’ল ‘প্রভাত সঙ্গীত’৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুর সঙ্গীতের মত শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত বলেই যে এই সঙ্গীতের নাম প্রভাত সঙ্গীত হ’ল তা নয়, মানুষের জীবনে রাত্রির অবসান ঘটিয়ে প্রভাতের শুভ সূচনা করার লক্ষ্যে এই সঙ্গীত রচনা৷ আমরা কেন এই পৃথিবীতে এসেছি? কীভাবে আমাদের জীবন সার্থক হবে? কীভাবে আনন্দময় হবে? কীভাবে আমাদের জীবনধারাকে– সমাজকে আনন্দময় করে তুলতে পারব? তারই নির্দেশনা পাই আমরা এই প্রভাত সঙ্গীতে৷
অপূর্ব ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দের সমন্বয়ে রচিত ও রচয়িতা কর্তৃক সুররোপিত এই প্রভাত সঙ্গীত সম্ভার দেখতে দেখতে হু–হু করে বাড়তে থাকল৷ তখন সব আনন্দমার্গীদের মুখে মুখে প্রভাত সঙ্গীত৷ চতুর্দিকে প্রভাত সঙ্গীতের অনুষ্ঠান৷ একে একে ক্যাসেটও বের হতে থাকল৷
এইভাম্ভ্রেব ১৯৯০ সালের ২০শে অক্টোবর–তাঁর মহাপ্রয়াণ দিবসের আগের দিন পর্যন্ত মাত্র আট বৎসর ছয় দিনে প্রভাত সঙ্গীতের সংখ্যা ৫০১৮তে এসে পৌঁছল৷ তারপর সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তাঁর মহাপ্রয়াণ হ’ল৷
তবে, আমরা জানি, মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী –তিনি তো স্বয়ম পরম চৈতন্যময় পরমপুরুষ–কেবল পাঞ্চভৌতিক দেহ ধারণ করে মানুষের সমাজে এসেছিলেন মানুষকে তাঁর জীবনের দিশা দেখা দেয়৷ প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের সঙ্গে চিরকালই ছিলেন, এখনও আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবেন৷ কেবল আমাদেরও সেই চেতনার উদ্বোধনের প্রয়োজন৷ তাহলে‘ই আমরা এই সত্য উপলব্ধি করব৷
আমাদের কাঁধে তিনি মহান দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন৷ নিপীড়িত মানবতার সর্বপত্মক মুক্তির জন্যে যে সর্বাত্মক জীবনাদর্শ–তিনি দিয়ে গেছেন, এই সুমহান অদর্শের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে নিপীড়িত মানবতাকে বাঁচাতে হবে৷ এই ধূলীর ধরাপাতে নব্য মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ তাই এসো আমরা প্রভাতসঙ্গীতের ভাষায় ও সুরে সমবেত কণ্ঠে গাই–
‘‘গান গেয়ে যাই, নূতনের গান গাই৷
রিক্ষ, রিক্ত মানবতাকে বদ্ধ–করতে চাই৷৷
মানবকে ক্লেষ দিয়েছে প্রচুর মানবের বেশে দানব অসুর৷
তাদের করিতে হবে আজ চুর, তাই ডাক দিয়ে যাই৷৷
মানুষের ঘরে যত ভাই–বোন, হাত ধরে’সবে কর আজ পণ৷
লড়ে’ যাব মোরা জীবনমরণ, মোদের উঁচু–নীচু নাই৷৷
- Log in to post comments