এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে আজ থেকে প্রায় দশ লাখ বছর আগে৷ তখন থেকেই মানুষের মনে সুখপ্রাপ্তির এষণা ছিল, আজও আছে, সর্বদা থাকবে৷ এই সুখপ্রাপ্তির এষণার দ্বারা অর্থাৎ একটা মানসিক অভীপ্সার দ্বারা–যার পূর্ত্তির জন্যে মানুষ চেষ্টাশীল হয়–প্রেষিত হয়ে সুদূর অতীতে ধর্ম জীবনে পদার্পণ করেছিল৷ এই এষণা কেবল মানুষের মধ্যেই রয়েছে, জন্তু–জানোয়ারের মধ্যে নেই ৷ তবে হ্যাঁ, যে সব জন্তু–জানোয়ার মানুষের সংস্পর্শে বাস করে, মানুষের সঙ্গে যাদের একটা বোঝাপড়া হয়েছে তাদের মধ্যেও অল্প পরিমাণে এই এষণা রয়েছে৷ কিন্তু স্ফুটতরভাবে রয়েছে কেবল মানুষের মধ্যে৷ এই এষণা মানুষের মধ্যে রয়েছে বলেই তার নাম মানুষ৷ ‘মানুষ’ শব্দের অর্থই হ’ল মনপ্রধান জীব৷ প্রারম্ভিক স্তরে নিছক সুখপ্রাপ্তির পেছনে দৌড়ানোতেই এই প্রয়াস সীমিত ছিল৷ ‘‘সুখং বাঞ্ছতি সবের্বাহি৷’’ এই সুখ পাবার প্রচেষ্টা থেকেই ধর্মের উদ্ভূতি৷ মানুষ লক্ষ্য করলে যে সে যা কিছু পাচ্ছে তা চাওয়ার তুলনায় খুবই কম৷ তার থেকে তার অনেক বেশী প্রয়োজন৷ তাও যখন সে পেলে তখন দেখলে সেটাও কম৷ আবার প্রয়াস চলল আরো বেশী পাবার জন্যে৷ তাতে সে যতটুকু পেল, ভেবেছিল তার দ্বারা তার সুখসম্প্রাপ্তি ঘটবে ও অতঃপর তার আর কোন অভাবক্ষোধ থাকবে না৷ কিন্ত দুঃখের সঙ্গে সে লক্ষ্য করলে যে তাতেও তার অন্তরের ক্ষুধা মিটছেনা–––– আরো চাই.....আরো চাই৷ অল্পেতে সন্তুষ্টি হ’ল না৷ মানুষ একেবারে শেষে গিয়ে আবিষ্কার করলে যে তার ক্ষুধা অনন্ত৷ যা সীমাবদ্ধ, যা সান্ত তার দ্বারা সে সুখ পেলে না৷ আবার তার খোঁজ খোঁজ শুরু হয়ে গেল৷ তখন সে বুঝতে পারল যে এই বিশ্বে কেবল একটি সত্তাই অনন্ত আর সেই সত্তাটি হচ্ছে পরমপুরুষ৷ মানুষ যদি সুখী হতে চায়, তৃপ্ত হতে চায়, তাকে পরমপুরুষের খোঁজ করতে হবে৷ তিনি ছাড়া আর কোন বস্তুই তাকে তৃপ্তি দিতে পারে না৷ এই সুখপ্রাপ্তির এষণা থেকেই ধর্ম জীবনের প্রারম্ভ হ’ল৷
‘‘তচ্চ ধর্মঃ সমুদ্ভূতঃ’’৷
তস্মাদ্ধর্মঃ সদাকার্যঃ সর্ব্বর্ণৈঃ প্রযত্নতঃ৷৷’’
এই যে পরমপুরুষকে পাবার প্রয়াস, এই যে ধর্মসাধনা এটা সকলের পক্ষেই করণীয় ৷ এটা সবাইকার অবশ্য কর্ত্তব্য৷ এই ধর্মসাধনাই মানুষের পরিচিতি বহন করে অর্থাৎ এই কাজ যে করে সে–ই মানুষ৷ যারা করে না তারা পার্থিব সুখ চায় না, চায় আনন্দ৷ কিন্তু প্রাথমিক সুখপ্রাপ্তির এষণাতে প্রেষিত হয়ে শেষ পর্যন্ত সে অনন্তের পথই গ্রহণ করে৷
মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সুখ ও আনন্দের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়৷ যখন অনুভূতির তরঙ্গ মনের ভেতরে থেকে যায় তখন তাকে বলব সুখ আর যখন তরঙ্গ শুধু মনের ভেতরেই নয়, বাইরেও চলে আসে অর্থাৎ যখন মানুষ অনুভব করে যে সুখের তরঙ্গ তার মনের ভেতরেও আছে, আবার বাইরে দশদিকেও রয়েছে তাকে বলব আনন্দ৷ লৌকিক জগতেও দেখবে যে কখনো কখনো লৌকিক সুখের তরঙ্গ এত বেশী হয়ে যায় যে মনে হয় বাইরে চারিদিকে সুখের তরঙ্গ বয়ে চলেছে৷ সে অবস্থায় নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যায় সুখ অত্যধিক হলে মানুষ চীৎকার করে ওঠে ...লাফাতে থাকে.....কখনো সে হাসে ...কখনো বা কাঁদতে থাকে৷ এমনি সুখাত্মক স্পন্দন যখন স্থায়ী হয়ে যায় তখন তাকে বলে আনন্দ৷ অর্থাৎ তার মনে যে সুখানুভূতির তরঙ্গ রয়েছে তা মনের ভেত র সীমিত থাকে না৷ এমনিতে সুখ সীমিত, কিন্তু কোন কোন সময় অত্যধিক হয়ে পড়লে বাইরে তা উপচে পড়ে৷ মানুষ তখন নিজেকে স্থির রাখতে পারে না৷ পরমপুরুষ আনন্দের আধার৷ তাই পরমপুরুষকে পেয়ে মানুষের আনন্দানুভূতি জাগে৷ আর তা পাওয়া গেলে পার্থিব সুখ ফিকে হয়ে যায়৷ কিন্তু গোড়ার দিকে এটাই হয়েছিল–মানুষ সুখপ্রাপ্তির চেষ্টা তো করেছিল, এগিয়েছিল–ধর্মজীবন আবিষ্কার করে মানুষ ধন্য হয়ে গেল৷ মানবের শরীরে আসাটা সার্থক হয়৷ তোমরা ধর্মজীবনে রয়েছ এটাই হচ্ছে মানব জীবনের পরাকাষ্ঠা ও মানবজীবনের সত্যিকারের পরিচয়৷ তোমাদের এটাও কর্ত্তব্য যে এই পৃথিবীর বেশী সংখ্যক লোক যাতে আনন্দের পথে আসতে পারে তার জন্যে প্রয়াসশীল হওয়া৷ তোমরাই কেবল ধর্মাচরণ করবে, অন্যেরা ধর্মজীবন যাপন করবে না –এটা বাঞ্ছনীয় নয়৷ সকলেই আনন্দের পথে চলুক এর জন্যে তোমাদের যে প্রয়াস, তার ফলে পৃথিবীতে শান্তির প্রতিষ্ঠা হবে, আর শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে মানুষ জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে থাকবে৷ লৌকিক জীবন ও আধ্যাত্মিক জীবন দুইয়ের মধ্যে সন্তুলন থাকলে সত্যিকারের প্রগতি ঘটবে৷ এছাড়া অন্যভাবে সত্যিকারের প্রগতি হতে পারে না৷
১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪, কাণপুর