মেদিনীপুরের যেটা কথ্য বাংলা সেটা কিন্তু ৰাংলা ভাষার বেশ একটা পুরোনো রূপ৷ ৰাংলার সাংস্কৃতিক জীবনেও মেদিনীপুরের স্থান খুবই উচ্চে৷ শত লাঞ্ছনার ভেতর দিয়ে দিন কাটালেও মেদিনীপুরের মানুষের প্রাণের স্পন্দন কখনও থেমে যায়নি৷ প্রাক্–পাঠান যুগে তো বটেই, পাঠান যুগে ও মোগল যুগেও এমন কি ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকেও সেখানে দেখেছি চুয়াড়–বিদ্রোহ–স্বাধীনতার প্রচণ্ড আন্দোলন, তারপর ’৪২ সালের প্রাণ–কাঁপানো নাড়া–দেওয়া আন্দোলন৷ এই মেদিনীপুরের পশ্চিম দিকটা, মানে ঝাড়গ্রাম মহকুমার কথ্য ভাষা মধ্য রাঢ়ীয় উপভাষা৷ ওরই লাগোয়া ময়ূরভঞ্জ ও সিংভূমেও ওই একই উপভাষার প্রচলন রয়েছে৷ এই মেদিনীপুরেরই দক্ষিণাংশে রসুলপুর নদীর মোহনা থেকে সুবর্ণরেখা নদীর মোহনা পর্যন্ত যে তীরভূমি তার কথ্য ভাষার আমি নাম দিয়েছি কাঁথি বাংলা৷ এই উপভাষায় ব্যঞ্জনের পূর্ণ উচ্চারণ খুব বেশী মাত্রায় রয়েছে৷ তথ্য প্রমাণে এই ধরণের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুবই স্বাভাবিক যে কবি কালিদাস এই অঞ্চলেরই মানুষ ছিলেন৷
যাই হোক আমাদের অতি পরিচিত রাঢ় ভূমির উত্তরাংশ যাকে সাধারণতঃ উত্তর রাঢ় বলি তা প্রাচীনকালে বর্দ্ধমানভুক্তি নামে পরিচিত ছিল৷ বর্ত্তমান বীরভূম, দুমকা, ধানবাদ, পশ্চিম মূর্শিদাবাদ, বর্দ্ধমান ও হুগলী নিয়ে মোটামুটি বিচারে ছিল উত্তর রাঢ় আর হুগলীর অংশবিশেষ, বর্ধমানের অংশবিশেষ, হাওড়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, সিংভূম, বালেশ্বর ও ময়ূরভঞ্জ জেলার অংশবিশেষ নিয়ে ছিল দক্ষিণ রাঢ় বা দণ্ডভূক্তি৷ এই দণ্ডভুক্তি ওড়িষ্যার ‘কেশরী’ রাজবংশের সময় (অনন্তকেশরী, যযাতি কেশরী) কয়েকবারই আক্রান্ত হয়েছিল৷ মারাঠা আক্রমণের সময় যখন ওড়িষ্যার চৌথ মারাঠাদের দিয়ে দেওয়া হয় তখন নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ বর্ধমান, ২৪ পরগণা, চট্টগ্রামসহ মেদিনীপুরের অধিকাংশই অংশতঃ ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেন৷ দণ্ডভুক্তি পাঠান ও মোগল যুগের গোড়ার দিকে ‘হিজলী’ নামে পরিচিত ছিল৷ আজ আমরা যাকে কাজুবাদাম বলি পর্তুগীজরা সেই বাদাম যখন এদেশে আনেন, তখন তার প্রথম চাষ এই হিজলীতেই হয়েছিল৷ তাই কাজু বাদামের আসল বাংলা নাম হিজলী বাদাম৷ এই বাদামের চাষ কেরলেও ব্যাপকভাবে হয়েছিল৷ আর সেখানকার কর্ষকেরা বাদামের বিনিময়ে যখন মূল্য চাইতেন তাঁরা ক্যাশ (নগদ পয়সা) ক্যাশ্যু’ রূপে উচ্চারণ করতেন৷ তার থেকে হিজলী বাদামের পরবর্তী নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ক্যাশুনাট্’৷ তুরস্কে সোহ্রাবর্দ্দ্ নামে একটি এলাকা থেকে জনৈক গাজী (বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ– অর্থাৎ কিনা ইসলাম ধর্মের জন্যে উৎসর্গিত–প্রাণ যে মানুষ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেও বেঁচে থাকেন তাঁকে বলা হয় ‘গাজী’ আর যিনি ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন তাঁকে ৰলে ‘শহীদ’৷) এই হিজলী পরগণায় এসেছিলেন ধর্মদেশনার উদ্দেশ্যে৷ তিনি এই হিজলীকে একটি আদর্শ ধর্মপীঠে পরিণত করতে চেয়েছিলেন৷ তাই তার নাম রেখেছিলেন মদিনাপুর৷ নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ এই হিজলী যখন ইংরেজদের হাতে দিলেন, তখন সেই মদিনাপুরের ইংরেজী নামকরণ হয়েছিল ত্তন্স্তুুত্রহ্মপ্সব্জ৷ স্থানীয় মানুষেরা মদিনাপুর বা ত্তন্স্তুুত্রহ্মপ্সব্জ নাম ব্যবহার না করে তাকে বলে থাকেন মেদিনীপুর৷ ইংরেজ আমলের শেষের দিকে তৎকালীন বাঙলার প্রধানমন্ত্রী (তখন মুখ্যমন্ত্রী বলা হত না) মিঃ এইচ্ এস্ সোহ্রাবর্দ্দী ছিলেন সোহ্ রাবর্দ্দ থেকে আগত এই গাজী পরিবারের সন্তান৷ এই মেদিনীপুর নানা কারণেই একটি আদর্শ জেলা৷
- Log in to post comments