প্রাণায়ামের মত প্রত্যাহার যোগও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়৷ কোন জীবিত সত্তার প্রাণবায়ুর গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার যে পদ্ধতি তারই নাম প্রাণায়াম৷ ‘প্রাণান্ যময়ত্যেষ প্রাণায়ামঃ*৷ আধ্যাত্মিক সাধক এই প্রাণায়াম–পদ্ধতির দ্বারা দেহের প্রাণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে৷
প্রাণায়াম সম্পর্কে একটা বিশেষ কথা মনে রাখতে হবে, প্রাণায়ামের সঙ্গে বিন্দুধ্যানের সম্পর্ক রয়েছে৷ প্রাণায়াম অভ্যাসকালে মনকে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে নিক্ষদ্ধ রাখতে হবে৷ প্রাণায়ামকে যদি বিন্দু ধ্যান থেকে বিচ্যুত করে নেওয়া হয় তাতে নিজের মানস শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হবে, মন চঞ্চল হয়ে পড়বে৷
অনুরূপভাবে, প্রত্যাহার যোগের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে ধারণার৷ ‘প্রত্যাহার’ শব্দের সমার্থক শব্দ হ’ল withdrawal৷ ধ্যান ও ধারণার মধ্যে পার্থক্য হ’ল এই যে, ধ্যান হ’ল কিছুটা স্থিরতামূলক, অর্থাৎ যাঁর ধ্যান করা হচ্ছে সেই উদ্দিষ্ট সত্তা স্থির.... অচঞ্চল পক্ষান্তরে ধারণায় মনের বিষয় সরে সরে যায়৷ অর্থাৎ ধারণা–ক্রিয়ার মধ্যে একটা চলমানতা রয়েছে কিন্তু ধ্যানক্রিয়ার মধ্যে কোন চলমানতা নেই৷
আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে প্রত্যাহারের গুরুত্ব অপরিসীম৷ সাধনার প্রারম্ভিক স্তরে সাধককে বিশ্বের বস্তুতান্ত্রিকতা থেকে মনকে প্রত্যাহার করতে হবে৷
এখন এই বস্তুজগৎ থেকে মনের সমস্ত বৃত্তিকে প্রত্যাহার করে নিয়ে তার পর কী করবে? এই প্রত্যাহৃত মানস বৃত্তিগুলোকে পরিচালিত করবে কার দিকে? প্রশ্ণ হ’ল, এই যে মানস বৃত্তিগুলো বাইরে থেকে তুলে নিয়ে একটা বিন্দুতে সংহত করলে কিন্তু কোন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালালে না, তাতে হবে কী?–না, সেই সমস্ত প্রত্যাহৃত অথচ অপরিচালিত বৃত্তি মনের প্রশান্তিকে ব্যাহত করবে, অবচেতন ও অচেতন মনকে চঞ্চল করবে৷ এটা ক্ষড়ই বিপজ্জনক অবস্থা৷ অতীতেও এমনটি হয়েছে, ভবিষ্যতেও এমনটি হতে পারে যে, সমর্থ গুরুর নির্দেশনা না নিয়ে যদি কোন সাধক কেবল বই পড়েই সাধনা শুরু করে দেয়, তাতে তার ক্ষতির সম্ভাবনা যথেষ্ট৷ তাই যখনই বাইরের জগৎ থেকে তোমার মানস বৃত্তি বা প্রবণতাকে প্রত্যাহার করে নিলে, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে কোন চলমান মানস বিষয়ের দিকে তাদের পরিচালিত করে দাও৷ সেই চলমান বিষয়টা কী? সেটা হ’ল তোমার চিত্ত৷ তোমার বিষয়ীভূত ‘আমি’৷ মনের চিত্ত অংশ গতিশীল....চলমান৷
তাহলে দেখছি, প্রত্যাহৃত মানস বৃত্তিগুলোকে চিত্তের দিকে চালাতে হবে, বাইরের বস্তুর দিকে নয়৷ সেক্ষেত্রে বাইরের বস্তুর দিকে মনের ছোটাটা বন্ধ হয়ে যায়, তার বদলে মানস বৃত্তিগুলোর গতি হয় মনের ভেতরের দিকে৷ এখানেই একটা কাজের কাজ হয়৷
মনকে বাইরের বস্তু থেকে তুলে নিলুম, কিন্তু চিত্তের দিকে চালালুম না৷ তাতে মনের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে বা হয়৷ তাই উপনিষদে বলা হয়েছে, /যচ্ছেদ্ বাঙমনসি প্রাজ্ঞঃ*৷
বুদ্ধিমান সাধক এই অবস্থায় কী করবেন? মনের সমস্ত প্রবণতা অভীপ্সাকে চিত্তের অভিমুখে চালিয়ে দেবেন৷ এখানে ‘বাঙ্’ বলতে মানসিক বৃত্তির বহির্মুখী গতির কথা বলা হচ্ছে৷ মনের বৃত্তিগুলোকে চিত্তের দিকে চালিয়ে দেবে৷ ‘প্রাজ্ঞঃ বাঙ্মনসি যচ্ছেদ’৷
‘তদ্ যচ্ছেজচ্ছান্তাত্মনি*৷ চিত্তে যখন ওই বহির্মুখী বৃত্তিগুলো সংহত হ’ল তার পরেও তো চিত্তের চলমানতা অক্ষুণ্ণ থাকছে৷ সে মনের পরিসীমার মধ্যেই চলাফেরা করছে, বাইরের বস্তু জগতের দিকে নয়৷ সে বাইরের কোন হাতীকে দেখছে না ঠিক কিন্তু মনের ভেতর তৈরী মানসিক হাতীটাকে দেখছে৷
‘তদ্যচ্ছেজ্জ্ঞানমাত্মন্’৷ এর পরের অন্যান্য প্রত্যাহৃত বৃত্তিসহ চিত্ত অহংয়ের দিকে পরিচালিত হবে৷ এই অহংতত্ত্ব হবে কর্ত্তৃ–‘আমি’ যা কিন্তু বস্তুসম্পৃক্ত বিষয়ভাবের আপাতঃ বিষয়ী ভাব৷ এখন এই যে অহংতত্ত্ব এই চলমান অবস্থায় না থাকলেও চলমানতার সামর্থ্য পুরোমাত্রায় রয়েছে৷ এটা চলতে পারে৷ এ নিজেকে আংশিক ভাবে চিত্তে রূপান্তরিত করে নিতে পারে৷ এ ধরনের সম্ভাবনা এর মধ্যে পুরোমাত্রায় আছে৷
এই জন্যে চিত্তকে (Done ‘I’) অহংতত্ত্বের দিকে চালিয়ে দিতে হবে৷ /আমি আছি* বোধকে নয়, /আমি করছি* বোধটা হ’ল অহংতত্ত্ব৷
‘জ্ঞানমাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ’৷ এখন এই যে জ্ঞানাত্মা বা অহংতত্ত্ব, তার বিরাট সম্ভাবনা তার মধ্যে রজোগুণের প্রভাব জবরদস্ত৷ ‘এই যে আমি করছি’ বোধ বা রজোগুণী শক্তি এটাও একটা বন্ধন৷ তাই সাধককে এই জ্ঞানাত্মা বা অহংকে মহৎতত্ত্বে টেনে তুলতে হবে৷ মহৎ তত্ত্বটা কী? ‘আমি আছি’ বোধই দার্শনিক পরিভাষায় হ’ল মহৎতত্ত্ব৷
এই মহৎতত্ত্বে গতিশীলতা নেই বললেই চলে কারণ এই মহৎতত্ত্ব হ’ল সত্ত্বগুণ সঞ্জাত৷ কিন্তু তোমরা জান যে সত্ত্বগুণ কোন ভাবকে কোন রূপ দিতে পারে না, সীমারেখায় রেখাঙ্কিত করতে পারে না৷ তবুও সেটা একটা বন্ধন তো আর যেখানেই বন্ধন সেখানে ভেতরে বাইরে সংঘর্ষ৷ ধর, তুমি কিছু একটা করছ এতে কি কোন সংঘর্ষ, চলমানতা নেই? যদিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন চিত্র বা আকৃতি নেই, তবুও তাতে সংঘর্ষ আছে–গতিশীলতা আছে৷
বলা হচ্ছে, ‘জ্ঞানাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ’৷ অহংতত্ত্বকে মহৎতত্ত্বে বিসর্জন দিয়ে দাও৷ তবুও৷ কিছুটা বন্ধন থেকেই যাচ্ছে৷ ধর, কোন একজন ভদ্রলোক কোন অসজ্জনকে খুব কড়া ভর্ৎসনা করছেন কারণ অসজ্জন লোকটি তাঁকে অসম্মান করেছেন৷ এটা কি অসঙ্গত? না, না, মোটেই অসঙ্গত নয়৷ এই হ’ল সাত্ত্বিক ক্রোধ৷ ক্রোধ জিনিসটা মুখ্যতঃ তামসিক, তবে কখনো কখনো সাত্ত্বিকও হতে পারে৷ সংসৃক্তে একে বলে সাত্ত্বিক ক্রোধ৷
‘তদ্ যচ্ছেৎ শান্তাত্মনি’৷ এই যে বিশুদ্ধ অস্তিত্ববোধ যেখানে সমস্ত বৃত্তিসহ চিত্ত ও পরে চিত্ত সহ অহংতত্ত্ব ও মহৎতত্ত্ব মিলে একীভূত হয়, এই সবকে প্রত্যাহার করে শান্তাত্মায় মিশিয়ে দিতে হয়৷ এই শান্তাত্মা যাবতীয় বন্ধনের ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ এই শান্তাত্মাই হ’ল জীবের পরমাগতি (Supreme Goal of human existence)৷
(পটনা, ২৪শে সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৮)