পুঁজিবাদের করালগ্রাসে মানব সমাজ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আজ থেকে দশ লক্ষ বছর পূর্বে মানুষের আবির্ভাব৷ মানুষ যখন আসে বন্যপ্রাণীদের মত মানুষেরও প্রধান কাজ ছিল আহারান্বেষণে ঘুরে বেড়ানো৷ আর সেদিন অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় সে ছিল অসহায়৷ তার চারদিকে ঘুরে বেড়াত নানান হিংস্র ও ভয়ঙ্কর পশুর দল৷ তাদের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করাটাই তখন তাদের কাছে প্রধান সমস্যা ছিল৷ আর সেই আদিম মানুষ তখন ভয় করত অন্যান্য মানুষদেরও৷ কখন তার আহূত খাদ্য অন্যেরা ছিনিয়ে নেয়৷ সব নিয়ে লড়াইটাই ছিল তার কাছে একমাত্র বাঁচার উপায়৷ আর তার জন্যে দরকার ছিল দৈহিক শক্তি৷ এইভাবে লড়াই করতে করতে যাদের দৈহিক শক্তি ছিল বেশী, সাহসী, লড়াইয়ে পটু মানুষের মধ্যে প্রাধান্য বাড়াল তাদের৷ আর তার ওপর মানুষ ছিল যূথবদ্ধ জীব৷ এই যূথবদ্ধতা সেই প্রতিকূল পরিবেশে জীবনধারণের পক্ষে অত্যাবশকীয় হয়েও উঠেছিল৷ এই অবথায় আদিম মানবগোষ্ঠী শক্তিশালী ও সাহসী মানুষের আজ্ঞাবহ রূপে কাজ করতে শুরু করল৷ এই শক্তিশালী, সাহসী মানুষদেরই বলা হয় ক্ষত্রিয়৷ এইভাবে সে যুগে ক্ষত্রিয় প্রাধান্যের যুগ বা ক্ষত্রিয়যুগের সূচনা হয়৷ পরবর্তীকালে মানুষ বুদ্ধির মূল্য বুঝতে শেখে৷ যে মানুষ উন্নততর যুদ্ধের উপকরণ, যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করতে পারল, যুদ্ধে উন্নত কৌশল অবলম্বন করতে পারল, তাদের জয়জয়কার শুরু হ’ল৷ ফলে ধীরে ধীরে সর্বসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত  মানুষ বা বিপ্রের কাছে মাথা নত করল৷ সমাজে এই বুদ্ধিমান মানুষের প্রধান্য, যাদের বলা হয় বিপ্র–সেই বিপ্র প্রাধান্য বৃদ্ধি পেল৷ আরও পরবর্তীকালে মানুষ যখন বস্তুর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার শিখল, ব্যবসা–বাণিজ্যের বিস্তার হ’ল, তখন আবার এই ব্যবসাদার বৈশ্যশ্রেণীর প্রাধান্য দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকল৷ ধীরে ধীরে বৈশ্যদের অর্থবলের কাছে বিকিয়ে যেতে লাগল ক্ষত্রিয়ের শক্তি ও বিপ্রের বুদ্ধি৷ সমাজে ধীরে ধীরে দেখা দিল বৈশ্য প্রাধান্যের যুগ বা বৈশ্য যুগ৷ যাকে আমরা সহজ কথায় বলি পুঁজিবাদী যুগ৷ এই পুঁজিবাদীদের ধ্যান–জ্ঞান হ’ল অধিক মুনাফা অর্জন৷ তারা চায় সমাজব্যবস্থা, প্রশাসন যেন তাদের মুনাফা অর্জনের পথে বাধা হয়ে না উঠতে পারে৷

বিপুল অর্থবলকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রশাসনকেও তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে৷

আজ সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে এই বৈশ্যযুগ৷ মুনাফা লোভী বৈশ্যরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের শোষণযন্ত্রকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে যে গোটা সমাজব্যবস্থার প্রকৃতিটাই বদলে গেছে৷ সমস্ত রকমের সামাজিক সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মীয়তা, মানুষের কর্তব্যবোধ সমস্তই আজ বিষিয়ে গেছে৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ মানুষে মানুষে লড়াই বাধিয়ে দিচ্ছে৷ ছিঁড়ে ফেলেছে মানুষের মধ্যে প্রীতি সম্পর্ক, সহযোগিতার সম্পর্ক, সহানুভূতির সম্পর্ক৷ জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে সমস্ত মূল্যবোধ৷ লড়াই লাগিয়ে দিয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরেরও৷ সবার মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে একটাই নেশা – অর্থ চাই, আরও অর্থ চাই৷ অর্থের জন্যে মানুষ তার সমস্ত কর্তব্যবোধ, সমস্ত বিবেকবোধ, শুভবোধ–সবকিছুকেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত৷

এমনিভাবে পুঁজিবাদী বিষে জর্জরিত গোটা মানব সমাজ, মানব সভ্যতা, সমগ্র মানবতা৷ পুঁজিবাদী বিষে জর্জরিত আজ সাহিত্য–সংস্কৃতি, তথাকথিত ধর্ম তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও৷ মানুষের আদি উৎস যে এক, তার লক্ষ্যও যে এক–মানুষ যে এক বৃহৎ পরিবারের সদস্য–একই পরমপিতার সন্তান–মানুষ এ সমস্ত ভুলে গেছে–পুঁজিবাদী বিষের প্রভাবে৷

তাই এই পুঁজিবাদ সমগ্র মানবতার শত্রু–মানব সভ্যতার শত্রু৷ এই পুঁজিবাদী আগ্রাসন থেকে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোটাই আজকের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷

আজকে এই পুঁজিবাদী মহাদানবের সঙ্গে সংগ্রামের একমাত্র হাতিয়ার আধ্যাত্মিকতাবাদ ভিত্তিক নব্যমানবতাবাদ তথা প্রাউট৷ অর্থশক্তিকে মানুষ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে সার্বিক মানব কল্যাণের পথে এগিয়ে যাবে৷ কিন্তু অর্থশক্তির দাস হয়ে চলবে না৷ যেমন বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানবতার সেবা করতে হবে, বিজ্ঞানের পদানত হলে চলবে না৷ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতির এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করে’ কীভাবে মানবতার উৎকর্ষ সাধন হয়–মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধন হয়, আজ সে চিন্তাই করতে হবে৷ বৈজ্ঞানিক আইনষ্টাইন বলেছিলেন–বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম  অন্ধ ও ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু৷ ধর্ম ও বিজ্ঞানকে এক সাথে নিয়ে এগোতে হবে৷ ধর্মকে অবজ্ঞা করে শুধু বিজ্ঞানকে নিয়ে চললে মানুষ বিজ্ঞানের দাসে পরিণত হবে, শুধু তাই নয় প্রযুক্তির যন্ত্রদানব ফ্রাঙ্কেষ্টাইন হয়ে মানুষকে, মানবতাকে নির্মমভাবে হত্যা করবে৷

অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ অর্থশক্তিকে যদি নীতি, ধর্ম ও মানবতার ওপরে স্থান দেওয়া হয়, যা পুঁজিবাদ করে থাকে, তাহলে মানবতা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ তাই মানবতাকে রক্ষা করতে, মানব সমাজকে বাঁচাতে পুঁজিবাদের অবসান একান্ত জরুরী৷ আর এই কাজে সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা দেবে প্রাউট৷