ফাঁসি অপরাধ দমনের পথ নয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

আর একটি নির্ভয়া কাণ্ড ঘটে গেল মহারাষ্ট্রে মুম্বাইয়ের সাকিনাকায়৷ নির্যাতিতার মৃত্যু হয় গত ১১ই সেপ্ঢেম্বর৷ যথারীতি দাবী উঠেছে অপরাধীর ফাঁসি চাই৷ কিন্তু অপরাধীর ফাঁসি দিলেই কি সমাজ অপরাধ মুক্ত হবে? এমনটাতো নয় যে আজ পর্যন্ত কোন অপরাধীর ফাঁসি হয়নে৷ এই পশ্চিমবাঙলাতেই এমন দৃষ্টান্ত আছে অপরাধীর ফাঁসি হয়েছে৷ কিন্তু তারপরেও কি অপরাধ দমন করা সম্ভব হয়েছে৷

ফাঁসি অপরাধীকে হত্যা করে, অপরাধ দমন করে না৷ যাঁরা অপরাধীর ফাঁসির দাবীতে সরব তারা অধিকাংশই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে এমন দাবি করে৷ অপরাধীর শাস্তিটাই তাদের কাছে বড়, সমাজের শুচিতা রক্ষার উপায়  নিয়ে ভাবার জন্যে মানসিক স্থিরতা তাদের নেই৷

রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, ঐক্য সংহতি বজায় রাখতে  সংবিধান ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা,আইনের শাসন থাকা অবশ্যই প্রয়োজন৷ তবে মৌলিক মানবীয় নীতির সঙ্গে  মানিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রের সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে৷ তবেই মানবিক ঐক্যের পথ সুগম হবে ও সমাজের শুচিতা রক্ষার সহায়ক হবে৷

সমাজকে অপরাধ মুক্ত করতে হলে অপরাধের উৎস খুঁজে বার করতে হবে৷ সব মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধী নয়৷ মানুষ পাশ ও রিপুর তাড়নায় অপরাধমূলক কাজ করে থাকে৷ ‘যা বাইরে উৎসারিত হয়ে মনভূমিকে প্রভাবিত করে তাকে বলা হয় পাশ, আর যা মনোভূমিতে উৎসারিত হয়ে বাহ্যিক জগতে বিস্তার লাভ করে তাকে বলা হয় রিপু (কণিকায় প্রাউট-দ্বাদশ খণ্ড)৷ মনের শুচিতা রক্ষা করতে হলে পাশ কে প্রতিরোধ করতে হয়, রিপুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়৷

মানুষ সাধারণত কতকগুলি সহজাত বৃত্তির তাড়নায় চলে৷ এই বৃত্তিগুলির কিছু মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়, কিছু মানুষকে অবনতির দিকে নিয়ে যায়৷ সেইরকমই কতকগুলি বৃত্তি যা মানুষকে অবনতির পথে নিয়ে যায়৷ তাই অপরাধের উৎস মানুষের মনোভূমি’ আইনের শাসন সেখানে পৌঁছাতে পারে না৷ বিচার ব্যবস্থা আইনের শাসন অপরাধ বাহ্যিক জগতে সংঘটিত হওয়ার পর৷ তাই ফাঁসি অপরাধীকে হত্যা করে’ নূতন অপরাধের পথ প্রশস্ত করে মানুষের মনোজগতে৷

মনের বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাংস্কৃতিক জগতের  বড় ভূমিকা আছে৷ মানুষের মনোজগত প্রভাবিত করে শিল্প সাহিত্য -সঙ্গীত সর্র্বেপরি আধ্যাত্মিক সাধনা৷ ব্রিটিশ শাসক  বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ গ্রন্থ দুটিকে নিষিদ্ধ করেছিল৷ কারণ ওই দুটি গ্রন্থ যুবসমাজকে দেশপ্রেম স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণাদায়ক যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল৷

আবার বিপরীতধর্মী শিল্প-কলা, সাহিত্য, সঙ্গীত, বাদ্য মানুষকে অবনতির পথে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করে৷ বর্তমান সমাজে নগ্ণচিত্র ও অশ্লীল সাহিত্যের মাধ্যমে যুব সমাজকে  নৈতিক অধঃগতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে৷ শাসক ও শোষক গোষ্ঠী যুবসমাজকে অধঃপথে ঠেলে দিয়ে স্থায়ী ভাবে শোষণ বজায় রাখতে এই ধরণের  অশ্লীল শিল্প-কলা সাহিত্যকে উৎসাহিত করছে৷ বর্তমান সমাজে যে ধরনের নির্মম নৃশংস অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার উৎস এইসব অশ্লীল নগ্ণ শিল্প-কলা সাহিত্য৷ বর্তমান সমাজের যাবতীয় সমস্যা-ব্যধির কারণ এই গুলি৷ তাই শুধু অপরাধীকে ফাঁসি দিলেই সমাজ অপরাধমুক্ত হবে না৷

সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়তে  মৌলিক মানবিক নীতির সঙ্গে মানিয়ে সংবিধান, শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, তেমনি মনোজগতের পাপকে প্রতিহত করতে রিপুকে নিয়ন্ত্রিত করতে উন্নতমানের উন্নত চিন্তার  শিল্প-কলা-সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে ও সর্বোপরি আধ্যাত্মিক সাধনা করতে হবে কারণ আধ্যাত্মিকতাই জীবনের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷

তাই সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রাউট নব্যমানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ তাই  প্রাউট তত্ত্বের মাধ্যমেই সর্বপ্রকার সামাজিক ব্যাধিগুলি  নির্মুল  করা সম্ভব হবে৷