ফেডারেল ফ্রন্ট ঃ কতটা প্রাসঙ্গিক

লেখক
সুকুমার সরকার

বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার জন্যে ম্যারাথন দৌড় শুরু করেছেন ৷ লক্ষ্য ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় বাহন ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’ অর্থাৎ আঞ্চলিক দলগুলি নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জাতীয় দলগুলিকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে বসা৷ কিন্তু কথা হল, এই যে আঞ্চলিক দলগুলি নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে ‘ফেডারেল ফ্রন্ট ’ তৈরী করা --- তা তো বর্তমানে ‘সোণার পাথর বাটি’!

মমতা, লালু, মুলায়ম, মায়াবতী, কেজরীওয়ালরা ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’ গড়বেন কীসের ভিত্তিতে? প্রত্যেকেই তো পরস্পর বিরোধী যুযুধান৷ প্রত্যেকেরই মত পথ আলাদা৷ কেবলমাত্র বিজেপিকে হঠানোই যদি উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে--- তা হলে অন্য কথা৷ কিন্তু তারপর? দেশ ও জনগণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে যদি ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার প্রস্তাব আসত৷ তাতো নয়৷

কেন নয়?

কারণ, পরস্পর বিরোধী এই আঞ্চলিক দলগুলি কোনো না কোন রাজ্যে ক্ষমতায় আছে বা থেকেছে৷ ক্ষমতায় থেকে বা থাকার সময় তারা তাদের নিজেদের রাজ্যগুলির প্রকৃতপক্ষে কতটা আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন?কতটা দারিদ্র্য ও বেকারসমস্যা --- এই মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানে করতে পেরেছেন৷ বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস সহ নানান দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কোরীতে প্রায় সবাই গ্রস্ত! এমতাবস্থায় কী করে তাঁরা ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার নামে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অলিন্দে যেতে চান?

কেন্দ্রের এই ক্ষমতায় যেতে চাওয়াটা যে দেশ ও জনগণের মৌলিক কল্যাণের জন্যে নয় তা তারা নিজ নিজ রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে বা থাকার সময় প্রমাণ করে দিয়েছেন৷

 তাহলে কীসের জন্যে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের এই ম্যারাথন দৌড়৷

উদ্দেশ্য স্পষ্ট৷ আঞ্চলিক দলগুলির প্রতিটি নেতাই স্বপ্ণ দেখছেন প্রধানমন্ত্রীত্বের অর্থাৎ ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া--- আসলে দেশ ও দশের কল্যাণ নয়৷

--- তাহলে কী জাতীয় দল কংগ্রেস , বিজেপি-ই শ্রেয় ?

---না, মোটেই শ্রেয় নয়! দুটি দলই পুঁজিবাদী শক্তির ক্রীড়নক৷ আঞ্চলিক ওই দলগুলিও পুঁজিবাদীদের ক্রীড়নক৷ তবে জাতীয় দলগুলি যে জাতীয় ভাবনা নিয়ে রাজনীতি করছে , তার একটি স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী দেশীয় ও বিদেশী পুঁজিবাদের মিশ্র অর্থনীতি সর্বস্ব দল৷ আর একটি হিন্দুত্ববাদী দেশীয় পুঁজিবাদীদের ক্রীড়নক একটি দল৷ দুটি দলই পুঁজিবাদী সংঘটন৷ এদের দ্বারাও রাষ্ট্রে ও জনগণে যথার্থ কল্যাণ হয়নি, হবেও না৷

--- তাহলে উপায় ?

--- উপায় আছে৷

চলমান বিশ্বে কোনো কিছুই থেমে থাকে না৷ কোন কিছুই একই নিয়মে চলে না৷ আজ ভারতবর্ষে আঞ্চলিক দলগুলি যে কারণে ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার তাগিদ অনুভব করছেন --- তা কী শুধুই কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল? নাকি এর পিছনে অন্য কোনো সমাজ -মনস্তত্ব আছে?

--- অবশ্যই আছে৷ বর্তমান লালু,মমতা, মুলায়ম, মায়াবতীর পরস্পর বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির ফেডারেল ফ্রন্ট --- অপ্রাসঙ্গিক হলেও আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যটা কিন্তু বর্তমান সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক৷

বিভিন্ন সময় এই ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার তাগিদ কিন্তু এই মনস্তত্ব থেকেই উঠে আসে ৷

এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, বর্তমানে এই পরস্পর বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলি ফেডারেল ফ্রন্ট কাঙ্ক্ষিত সাফল্য যে দেবেনা তা আলোচনায় স্পষ্ট৷ কারণ এই দলগুলির মধ্যে একক কোনো দার্শনিক মতাদর্শ নেই---যা এঁদেরকে একসূত্রে গেঁথে রাখবে৷ বরং এই দর্শনহীন পরস্পর বিরোধী দলগুলির ঐক্যমতে সরকার গড়া হলে, বহিশত্রুর আক্রমণ বাড়বে৷ অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে৷ পরস্পরের দড়ি টানাটানির লড়াইয়ে উন্নয়ন শিকেয় উঠবে ৷ দেশের অখন্ডতাও বিঘ্নিত হতে পারে৷

সুতরাং আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির দরকার আছে বলেই পরস্পর বিরোধী দলগগুলি নিয়ে যেভাবে ফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা হচ্ছে তা মোটেই যুক্তি সংগত বলে মনে হচ্ছে না৷ দরকার একক কোনো বৃহত্তর সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শনের ছত্রছায়ায় আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷ যেখানে প্রতিটি ভৌম অঞ্চলে সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির উন্নয়ন আর প্রতিটি ভৌমঞ্চলের সম্পদ ও সম্ভাবনার যথাযোগ্য উপযোগ গ্রহণের মাধ্যমে যুক্তিসংগত বন্টণ সম্ভব৷ আশার কথা একুশ শতকের জন্যে এই নব্যনীতিচেতসার নোতুন সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শনের আবির্ভাব ঘটে গেছে৷ বুদ্ধিজীবীরা ও রাজনীতিবিদরা তা জেনেও গেছেন কিন্তু জেনেও সেই মতো নোতুন এই প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব (প্রাউট)-এর প্রতিষ্ঠার জন্যে তৎপর হচ্ছেন না৷

---কেন তৎপর হচ্ছেন না?

--- আসলে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্র ধবংসের পর পুঁজিবাদ যেভাবে একচ্ছত্র শাসন -শোষনের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে, সেখানে তারা তাদের নিজেদের কবর খুঁড়ে প্রাউট দর্শনকে আনতে দেবেনা৷ তাই সমাজ মনস্তত্ত্বে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির সুর ধবনিত হলেও সেই সুরকে তারা সাম্প্রদায়িকতা ও কর্র্পেরেট ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে ভিন্নপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে৷

 বর্তমান ভারতবর্ষে চলছে দেশীয় পুঁজিবাদ বনাম বিদেশী পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব৷ বিজেপি, বিশেষ করে বিজেপির পিছনে পরিচালকশক্তি আর এস এস দেশীয় পুঁজিবাদের তল্পিবাহক৷ আর কংগ্রেস কিছুটা বিদেশী পুঁজিবাদের তল্পিবাহক ৷ আঞ্চলিক দলগুলি এদের নিষ্পেষণে পর্যুদস্ত৷ আর এই মানসিকতা থেকেই ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার তৎপরতা কিন্তু তারা নিজেরাও কোনো কোনভাবে সাম্প্রদায়িকতাবাদ, জাতি (কাস্ট)-বাদ , পুঁজিবাদ দ্বারা পরিচালিত৷ এদের দ্বারাও দেশ ও জনগণের কল্যাণ ভাবনা ওই সোণার পাথর বাটিই থেকে যাবে৷

---তাহলে বাকি থাকল প্রাউট৷

--- হ্যাঁ, কেবলমাত্র প্রাউট, প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্বে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠাই একমাত্র সমাধান৷ শুধু ভারতবর্ষ নয় সমগ্র বিশ্বের জন্যে৷