ফেসবুক, ওয়াটসআপ, ইন্টারনেট ঃ মানস-অর্থনৈতিক শোষণের  নব ছলাকলা

লেখক
সুকুমার সরকার

একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিপদ পুঁজিবাদের মানস-অর্থনৈতিক শোষণ৷ এর সূক্ষ্ম জাল এমনভাবে বিস্তৃত, যা সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে  পুঁজিবাদ বিরোধী কমিউনিষ্ট, ধর্মমতের ধবজাধারী মোল্লা, পাদ্রি, পুরোহিতেরা পর্যন্ত এর জালে জড়িয়ে যাচ্ছে৷ মোল্লা, পাদ্রি, পুরোহিতেরা তো চিরকালই জেনে বা না জেনে স্বার্থান্বেষীদের সমর্থন করে চলে৷ প্রশ্ণ আসতে  পারে, কমিউনিষ্টরা পুঁজিবাদীদের  ক্ষপ্পরে পড়লো কী করে?--- এটা আসলে পুঁজিবাদীদের মানস-অর্থনৈতিক শোষণের কৌশল৷

কমিউনিজম দর্শনে মানুষের প্রাথমিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) পূর্তি র  গ্যারান্টির কথা থাকলেও, পুঁজিবাদীদের মানস-অর্থনৈতিক শোষণ ঠেকাবার মতো কোনো মানস-অর্থনৈতিক দর্শন দিশা নেই৷ তাছাড়া বেশিরভাগ  মানুষ তো এটাও জানে না যে, মানস অর্থনৈতিক শোষণটাই বা কী? এই শোষণের চরিত্র কেমন? পুঁজিবাদীরা কিভাবে এই মানস অর্থনৈতিক শোষণের  জাল বিস্তার  করে চলেছে?

একবিংশ শতাব্দীর জন্য বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে) মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রথম মানস-অর্থনৈতিক  দর্শন দেন তাঁর ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বে’’ (প্রাউট)-এর দর্শন আলোচনায়৷ ইতোপূর্বে অর্থনৈতিক দর্শনের আলোচনায় ‘সাধারণ অর্থনীতি’ ও ‘বানিজ্যিক অর্থনীতি’ ও তাদের শাখা-প্রশাখা নিয়েই যা কিছু চর্চা হয়েছে৷ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার গণ-অর্থনীতি ও মানস-অর্থনীতি নামক দুটি নোতুন বিষয় যোগ করেন৷ পরবর্তীতে গণর্থনীতি নিয়ে ডক্টর অমর্ত্য সেন কিছু  কাজ করলেও মানস অর্থনীতির  ব্যাপারটা নিয়ে অর্থনৈতিক  পর্যায়ে কোনো কাজই হয়নি৷ আসলে অর্থনীতি নিয়ে  অন্য যাঁরা যতটুকু কাজ করেছেন, তাঁরা নিজেরাও মানস-অর্থনীতির  শিকার৷ না হলে গণর্থনীতির কথা বলে নোবেল পুরস্কার  পেয়েও ডক্টর অমর্ত্য সেন কী করে  ভারতবর্ষের  জন্য গ্যাট চুক্তির  পক্ষে মত দেন?

আসলে  এ সবও  ওই পুঁজিবাদীদের মানস-অর্থনৈতিক  শাসন শোষণের ছলাকলা---যা  অমর্ত্য সেনেরা  বুঝতেই  পারেন নি৷ কখন কীভাবে  পুরস্কারের মোহে পুঁজিবাদী -দের  মানস-অর্থনৈতিক শোষণের জালে পা দিয়েছেন৷ এমন ধারা অবস্থা এখন সর্ব বিষয়ে, সর্বত্র চলছে৷

এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, মানস-অর্থনৈতিক শোষণ কী?

শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, সূক্ষ্মভাবে মানুষের মানস-ভূমি ও মানস-আধ্যাত্মিক ভূমি পর্যুদস্ত করে যে আর্থ-সামাজিক ও আধ্যাত্মিক শোষণ চালানো হয়, তাকে মানস-অর্থনৈতিক  শোষণ বলে৷ 

আমরা শুধু ভাবি কোনো ভৌম-জাতিসত্তার শিল্প-সংস্কৃতি ধবংস করাটাই বুঝি মানস-অর্থনৈতিক শোষণ৷ মানস-অর্থনৈতিক শোষণের রূপ বহুবিধ ও আরও বেশি সুক্ষ্ম৷ সুক্ষ্মভাবে আজকের পুঁজিবাদীরা  ভৌম-মানুষের শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্মমত, প্রথা-পদ্ধতি তুলে ধরার মধ্য দিয়েও তাদের মানস অর্থনৈতিক শোষণ চলিয়ো যাচ্ছে৷ আমরা ভাবছি বেশ তো, ভালোই হচ্ছে৷ এতে করে বিভিন্ন ভৌম জাতি সত্তার ভৌম ধর্মমত, ভৌম প্রথা-পদ্ধতি উঠে আসবে৷ কিন্তু আমরা এটা ভাবছি না যে, আজকের সংস্কৃতি মিলনের সংস্কৃতি৷ আজকের যুগ সংশ্লেষনের যুগ৷ আজকের যুগ বিশ্লেষনের যুগ নয়৷ পরস্পর বিরোধী প্রথা পদ্ধতি তুলে ধরে মিলন সংস্কৃতি ধবংস করার যুগ আজকে নয়৷

অথচ পুঁজিবাদীরা কিন্তু তাদের প্রচার যন্ত্রে, তাদের মুখপত্রে এ সবই করছে৷  সুক্ষ্মভাবে তারা পরস্পরের মধ্যে বিরোধ বাধানোর চেষ্টা করছে৷ কেননা, মিলন সংস্কৃতির  ধর্ম হল পরস্পরের মেলা মেশায়  বিরোধাত্মক প্রথা-পদ্ধতির বিলুপ্তি৷ পুঁজিবাদীরা বিরোধকেই  চাগিয়ে তুলছে৷ আমরা  এই সুক্ষ্ম ছলাকলা বুঝতে পারছি  না৷

এখানে শেষ নয়! সমাজে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন ধর্মমত, বিভিন্ন বর্ণের  মানুষের  মধ্যেই শুধু বিরোধ বাধাচ্ছে না ব্যষ্টি  মানুষের  বিরোধকে চাগিয়ে তুলছে৷ অর্থাৎ মানুষ নিজের সঙ্গে নিজেই বিরোধ করছে! মানুষকে একক বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে!

পুঁজিবাদীরা প্রযুক্তি বিজ্ঞানের  সর্র্বেচ্চ কলা কৌশল ব্যবহার করছে৷ আজকের মানস-অর্থনৈতিক শোষণের রূপরেখা  এই জায়গায়  দাঁড়িয়ে আছে৷ পুঁজিবাদীদের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি হলো ফেসবুক, ওয়াটসআপ, ইন্টারনেট ইত্যাদির মতো মাধ্যম গুলো৷ যা হাওয়ায় ভেসে ভেসে মানুষের মনের গহন কোণে প্রবেশ করে মানুষের ব্যষ্টি, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কৃতি সবেতেই ঘুন ধরিয়ে দিচ্ছে৷ মানস-অর্থনৈতিক শোষণের  এই ফাঁদে পা দিয়ে আমরা সর্বনাশের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি৷

মানস-অর্থনৈতিক শোষণের  এই ছলাকলা  পূর্বাহ্ণেই বুঝতে পেরে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরজ্ঞকার তার বিরুদ্ধে মানস-অর্থনৈতিক দর্শন দিয়ে গেছেন৷ গান লিখে গেছেন৷

বিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তিকে  আমরা অবশ্যই গ্রহণ করবো৷ তবে যে প্রযুক্তি বা যে কোনো প্রযুক্তির ভালো দিকগুলি৷

মানস-অর্থনৈতিক শোষণ যে স্তর থেকে শোষণের জাল বিস্তার করে, তা খুবই সূক্ষ্ম স্তর৷ এর প্রতিরোধ ব্যবস্থাও তাই হওয়া উচিত সুক্ষ্মস্তরেই৷ মানস-ভৌমিক স্তর ও মানস-আধ্যাত্মিক  স্তর মানস-অর্থনৈতিক শোষণের অধিক্ষেত্র৷

মানস-অর্থনৈতিক দর্শনও তাই মানস-ভৌমিক স্তর ও মানস-আধ্যাত্মিক স্তরে কাজ শুরু করেছে৷

মানস-ভৌমিক স্তর ও মানস-আধ্যাত্মিক স্তরের আকর্ষণ তীব্র হলেও তার গতি সূক্ষত্বের  দিকে৷ স্থূল শারীরিক সুখভোগ সেখানে কম৷ অন্যদিকে মানস অর্থনৈতিক স্তরে  শোষকদের প্রলোভনের  বিষয় বস্তু স্থূল হওয়ায়  তার দিকে  আকর্ষণ  তীব্রতর৷ কারণ এর সঙ্গে  শারীরিক সুখভোগের  বিষয় জড়িত৷ মানস অর্থনৈতিক শোষকেরা  মানুষের মস্তিষ্কের  সুক্ষ্ম কোষে কোষে  জাল বিস্তার  করে চলছে৷ একক বিচ্ছিন্ন  মানুষ  সেই ফাঁদে পা দিয়ে  সারাদিন ফেসবুক, ওয়াটস আপ, ইন্টারনেটে মশগুল হয়ে আছে৷ এতে করে মানুষের  মনের সৃষ্টিশীলতাতেই  শুধু বিঘ্নই ঘটছে  না৷ মারণ নেশার মতো মোহগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে  প্রতিটি মানুষ৷ পরিবারে বাবা-মা , স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক, অফিসে মালিক-কর্মচারী, পথে ঘাটে ড্রাইভার-যাত্রী, মঠে-মন্দিরে সাধু-সন্ন্যাসী সকলেই৷ সকলে এত মোহগ্রস্ত  হলে সমাজ কারা চালাবে? পুঁজিবাদীরা এই সুযোগটাই নিয়েছে৷ সুতরাং পুঁজিবাদীরা নিশ্চিন্ত তাদের প্রতিহত করার কেউ নেই৷ যারা আছে, যাদের হাতেে প্রতিরোধ  করার মতো দর্শন আছে তাদেরকে নিয়ে পুঁজিবাদীরা সাপুড়ের ঝাঁপির বিষ দাঁত ভাঙা বিষাক্ত সাপের মতো খেলছে৷ পুঁজিবাদীদের সেই ঝাঁপি হলো  এই মাধ্যমগুলো৷  আমরা জেনে বা না জেনে  পুঁজিবাদীদের সেই ঝাঁপির মধ্যে নাচছি৷ আর আত্মতুষ্টি পাচ্ছি নিজেদের প্রচারের  লাইক কমেন্ট দেখে৷

সমাজের  সর্বস্তরে  বিপদটা এখানেই৷ এমনও  দেখা গেছে  কোল থেকে সন্তান  পড়ে যাচ্ছে, মার খেয়াল নেই৷ মার চোখ আটকে  আছে ফেসবুকের  লাইক-কমেন্টে৷

এই বিপদ অমর্ত্য সেনেরা বুঝতে পারেননি৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বুঝেছিলেন৷

---পুঁজিবাদীরা এসব কেন করছে?

উত্তর সবাই জানেন৷ আসলে মোহগ্রস্ত  মানবসমাজকে শাসন ও শোষণ করা সহজ৷

একুশ শতকের এই মানস-অর্থনৈতিক  দর্শনের যুগে মানুষকে এই মোহগ্রস্ত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ বিজ্ঞানের  প্রযুক্তিকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে তবে তা বৃহত্তর মানব কল্যাণের জন্য৷  মানুষকে একক বিচ্ছিন্ন করার জন্যে  নয়! যারা একক বিচ্ছিন্ন হয়ে, ফেসবুকে ইন্টারনেটে, ওয়াটসআপে মোহগ্রস্ত  হয়ে পড়ছেন, তারা বেরিয়ে আসুন! মানস-অর্থনৈতিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত মানস-অর্থনৈতিক  দর্শনের মানস-আধ্যাত্মিক  সাধনার পথ বেছে নিন!

অনেকে এই মাধ্যমগুলিকে বিপ্লবের হাতিয়ারও করে ফেলেছেন৷ মনে রাখতে হবে হাওয়ার বিপ্লব হাওয়ায় মিশে যাবে৷ বাস্তবের মাটিতে বর্ষিবে না৷

কেননা এ মাধ্যমে কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ কারো  কোনো দায়ও নেই৷ এ মাধ্যমকে  এখন বেশিরভাগ  মানুষ বিশ্বাসও  করে না৷ ফালতু মনে করে৷ সুতরাং এর থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে৷ নইলে সমাজ-রাষ্ট্রের সমূহ বিপদ হবে!  প্রতিকার  যাঁদের  হাতে আছে, তাঁরা  যদি কমিউনিষ্টদের মতো বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কখন নিজেরাই মোহগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেন বুঝতে না পারেন, তাহলে মহাকালও তাঁদেরকে ক্ষমা করবে না!