‘রাধা’ হল সাধকের জীবনের একটা ভাব৷ ব্রজভাব, গোপীভাব ও রাধাভাবের মধ্য দিয়ে সাধক এগিয়ে চলে পরম লক্ষ্যের পানে৷ এই রাধাভাব জাগ্রত হবার পরেই সাধক তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে৷ আবার বৈষ্ণব তন্ত্র মতে প্রতিটি মানুষের মূলাধারস্থিত জীবভাব বা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে রাধা বা হ্লাদিনী শক্তি বলে৷ সহস্রার চক্রে রয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ৷ এই রাধাকৃষ্ণের মিলনেই সাধকের জীবনের সার্থকতা৷ তাই প্রতিটি সাধকই রাধা৷ রাধা বলতে কোন গোপী বা নারীকে বোঝায় না৷ শ্রীকৃষ্ণের সময়ে বৃন্দাবনে ‘রাধা’ নামে কেউ ছিল না৷
শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক পুরুষ৷ তিনি এসেছিলেন আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বে৷ প্রচলিত ধারণায় তাঁর সম-সাময়িক মহামুনি ব্যাসদেব মুখ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণের বাল্য জীবন নিয়ে ভাগবত ও মহাভারত তাঁর কর্মজীবন নিয়ে মহাভারত ও হরিবংশ রচনা করেন৷ গীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী৷ কিন্তু এই ভাগবতে, মহাভারতে, হরিবংশে বা গীতায় কোথাও ‘রাধা’ নামে কোন নারীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না৷ শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের কাহিনী বৃন্দাবন লীলাই ভাগবতে প্রাধান্য পেয়েছে৷ কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এই ভাগবত৷ কিন্তু এই ভাগবতে কোথাও রাধার নাম গন্ধও নেই৷ অথচ আজকাল রাধা বিনা কৃষ্ণের কোন মন্দির নেই, রাধাবিনে কৃষ্ণের নাম নেই, রাধা শব্দ বৈষ্ণবগণের মজ্জার সঙ্গে মিশে আছে৷ এই রাধাকে নিয়ে কৃষ্ণের সম্পর্কে যে সব আদি রসাত্মক কাহিনী কিছু বৈষ্ণব সাহিত্যের বা পালা কীর্তনের মাধ্যমে বাংলার গ্রামে গ্রামে প্রচার করা হয়েছে বা আজও হচ্ছে, তা কোন ভদ্র রুচিসম্পন্ন মানুষ ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসঙ্গে বসে শুণতে বা আলোচনা করতে পারেন না৷ এখানে কৃষ্ণকে দেখান হয়েছে একটা নারীলোলুপ, চরিত্রহীন, লম্পট হিসেবে৷ যেখানে তিনি সম্পর্কে মামী, বয়সে বড় আয়ানপত্নী রাধার সঙ্গে অবৈধ পরকীয়া প্রেম করছেন, মেয়েদের বস্ত্রহরণ করছেন, মাখন চুরি করছেন৷ আবার অনেক তথাকথিত গুরু গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও কৃষ্ণের প্রতি তাদের ভক্তির সুযোগ নিয়ে কৃষ্ণ সেজে রাসলীলায় মাতোয়ারা হয়, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়৷
এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে?
এই রাধা তত্ত্ব নিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন৷ পাঠকের সুবিধার জন্য সেখান থেকে কিছুটা তুলে দিলাম৷
‘‘ভাগবতের এই রাসপঞ্চাধ্যায়ের মধ্যে ‘রাধা’ নাম কোথাও পাওয়া যায় না৷ বৈষ্ণবাচার্যদের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট৷ তাহারা টিকা টিপ্পনীর ভিতর পুনঃ পুনঃ রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়াছেন, কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নেই৷ গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈর্ষার প্রমান স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে, তাহারা পদচিহ্ণ দেখিয়া অনুমান করিয়াছিল যে, কোন একজন গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন৷ কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রমমাত্র৷ শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকেও লইয়া অন্তর্হিত হইলেন, এমন কথা নাই ও রাধার নামগন্ধও নাই৷
রাসপঞ্চাধ্যায়ে কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নাই৷ ভাগবতে কেন, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশ বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নাই৷ অথচ এখানকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা৷ রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণ নাম নাই৷ রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্তি নাই৷ বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন৷ যদি মহাভারতে, হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে বা ভাগবতে ‘রাধা’ নাই, তবে এ ‘রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে?
রাধাকে প্রথমে ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে দেখিতে পাই৷ উইল্সন্ সাহেব বলেন যে, ইহা পুরাণগণের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বলিয়াই বোধ হয়৷ ইহার রচনা প্রণালী আজিকালিকার ভট্টাচার্য্যদিগের রচনার মত৷ ইহাতে ষষ্ঠী মনসারও কথা আছে৷ ---সর্বশেষে প্রচারিত হইলেও ব্রহ্মবৈবর্ত্ত বাঙলার বৈষ্ণবধর্মের উপর অতিশয় আধিপত্য স্থাপন করিয়াছে৷ জয়দেবাদি বাঙালী বৈষ্ণব কবিগণ, বাঙলার জাতীয় সঙ্গীত, বাঙালার যাত্রা মহোৎসবাদির মূল ব্রহ্মবৈবর্ত্তে৷ তবে ব্রহ্মবৈবর্ত্তকার কথিত একটা বড় মূল কথা বাঙালার বৈষ্ণবেরা গ্রহণ করেন নাই,অন্ততঃ সেটা বাঙালীর বৈষ্ণব ধর্মে তাদৃশ পরিস্ফুট হয় নাই---রাধিকা অয়ান পত্নী বলিয়া পরিচিতা, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত্তের মতে তিনি বিধি বিধানানুসারে কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নী৷ সেই বিবাহবৃত্তান্তটি সবিস্তারে বলিতেছি৷
‘‘একদা কৃষ্ণসহিত নন্দ বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন৷ তথাকার ভাণ্ডীরবনে গোপগণকে চরাইতেছিলেন৷ সরোবরে স্বাদুজল তাহাদিগকে পান করাইলেন ও পান করিলেন৷ বালককে বক্ষে লইয়া বটমূলে বসিলেন৷ হে মুনে! তারপর মায়াতে শিশু শরীর ধারণকারী কৃষ্ণ অকস্মাৎ মায়ার দ্বারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কাননান্তর শ্যামল ঝঞ্চাবাত, মেঘশব্দ, দারুণ বজ্রশব্দ, অবিরল বৃষ্টিধারা ও বৃক্ষসকল কম্পমান হইয়া পতিতস্কন্ধ হইতেছে, দেখিয়া নন্দ ভয় পাইলেন৷ গোবৎস ছাড়িয়া কিরূপেই বা আপনার আশ্রমে যাই, যদি গৃহে না যাই, তবে এই বালকেরই বা কি হইবে, নন্দ এইরূপ বলিতেছেন, শ্রী হরি তখন কাঁদিতে লাগিলেন মায়াভয়ে ভীতিযুক্ত বাপের কন্ঠ ধারণ করিলেন৷ এই সময় রাধা কৃষ্ণের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন৷’’
রাধার অপূর্ব লাবণ্য দেখিয়া নন্দ বিস্মিত হইলেন, তিনি রাধাকে বলিলেন, ‘‘আমি গর্গমুখে জানিয়াছি, তুমি পদ্মার অধিক হরির প্রিয়া আর ইনি পরম নির্গুন অচ্যুত মহাবিষ্ণু তথাপি আমি মানব, বিষ্ণু মায়ায় মোহিত আছি৷ হে ভদ্রে! তোমার প্রাণনাথকে গ্রহণ কর যথায় সুখী হও, যাও৷ পশ্চাৎ মনোরথ পূর্ণ করিয়া আমার পুত্র আমাকে দিও৷’’
এই বলিয়া নন্দ রাধাকে কৃষ্ণ সমর্পণ করিলেন৷ রাধাও কৃষ্ণকে কোলে করিয়া লইয়া গেলেন৷ দূরে গেলে রাধা রাস মণ্ডল স্মরণ করিলেন, তখন মনোহর বিহারভূমি সৃষ্টি হইল৷ কৃষ্ণ সেইখানে নীত হইলে কিশোরমূর্ত্তি ধারণ করিলেন৷ তিনি রাধাকে বলিলেন ‘যদি গোলকের কথা স্মরণ হয় তবে যাহা স্বীকার করিয়াছি, তাহা পূর্ণ করিব’৷ তাঁহারা এইরূপ প্রেমালাপে নিযুক্ত ছিলেন, এমন সময়ে ব্রহ্মা সেইখানে উপস্থিত হইলেন৷ তিনি রাধাকে অনেক স্তবস্তুতি করিলেন৷ পরিশেষে নিজে কন্যাকর্তা হইয়া, যথাবিহিত বেদবিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণে সম্প্রদান করিলেন৷ তাঁহাদিগকে বিবাহ-বন্ধনে বদ্ধ করিয়া তিনি অন্তর্হিত হইলেন৷ অয়ানের সঙ্গে রাধিকার যথাশাস্ত্র বিবাহ হইয়াছিল কিনা, যদি হইয়া থাকে, তবে পূর্বে কি পরে হইয়াছিল, তাহা ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে পাইলাম না৷ রাধাকৃষ্ণের বিবাহের পর বিহার বর্নন৷ বলা বাহুল্য যে, ব্রহ্মবৈবর্ত্তের রাসলীলাও ঐরূপ৷
যাহা হউক, পাঠক দেখিবেন যে, ব্রহ্মবৈবর্ত্তকার সম্পূর্ণ নতুন বৈষ্ণব ধর্ম সৃষ্ট করিয়াছেন৷ সে বৈষ্ণবধর্মের নামগন্ধ বিষ্ণু বা ভাগবত বা অন্য পুরাণে নাই৷ রাধাই এই নূতন বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রস্বরূপ৷ জয়দেব কবি গীতগোবিন্দ কাব্যে এই নূতন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বন করিয়াই গোবিন্দগীতি রচনা করিয়াছেন৷ এই ধর্মবলম্বন করিয়াই শ্রীচৈতন্যদেব কান্তরাসাশ্রিত অভিনব ভক্তিবাদ প্রচার করিয়াছেন৷ বলিতে গেলে সকল কবি, সকল ঋষি, সকল পুরাণ, সকল শাস্ত্রের অপেক্ষা ব্রহ্মবৈবর্ত্তকারই বাঙালীর জীবনের উপর অধিকতর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছেন৷’’ (কৃষ্ণ চরিত্র)
- Log in to post comments