রাজনীতি ও দুর্নীতির মূলে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

রাজনীতি বলতে সাধারণত বোঝান হয় রাজার নীতি বা রাজ্য শাসন বিষয়ে নীতি শাস্ত্র৷ রাজার নীতি--- রাজনীতি---ষষ্ঠী তৎপুরুষ৷ প্রকৃত অর্থে রাজনীতি--- নীতির রাজা বা শ্রেষ্ঠ নীতি৷ তা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে,  ধর্মের ক্ষেত্রে যে নীতি জড় জীব সর্ব অস্তিত্বের সার্বিক কল্যাণের পথ নির্দেশনা দেয় তাই রাজনীতি বা নীতির রাজা৷

পরাধীন ভারতে একদল দামাল দস্যি ছেলেদের কাছে রাজনীতি ছিল দেশের মুক্তির জন্যে-আত্মত্যাগ জীবন বলিদান৷ কত-শত তরুণ-তরুণীর আত্মত্যাগ বলিদানে কত শত মা-বোন-স্ত্রীর অশ্রুতে ভিজে সেই স্বাধীনতা এসেছে৷ দুঃখের বিষয় দেশের স্বাধীনতার জন্যে রাজনীতি করতে এসে যাঁরা অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে, সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন এমন কি হাসতে হাসতে জীবন বিসর্জন দিয়েছে, স্বাধীন ভারতে রাজনীতিবিদদের তাঁদের কথা মনেই থাকলো না৷ তাঁদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, প্রাণ বিসর্জন স্বাধীন দেশের নেতাদের চরিত্রে কোন প্রভাব পড়লো না৷ আজ স্বাধীন ভারতে রাজনীতির সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে দুর্নীতি৷ অবশ্য ভারতীয় রাজনীতিতে দুর্নীতিও ক্ষমতার দাম্ভিকতার লক্ষণ স্বাধীনতার আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল৷ স্বাধীন ভারতে ৭৭ বছর ধরে তার বিস্তার ঘটছে৷

সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে এক বৈঠকে এক শ্রেণীর নেতা মন্ত্রী বিধায়ক পুরসভা পঞ্চায়েতের প্রশাসনের কর্তা-ব্যষ্টিদের দিকে আঙুল তুলে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগে এনেছেন৷ সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে আশানুরূপ জয় পেলেও বেশ কিছু পুর এলাকায় দলের ফল মোটেই ভালো নয়৷ মুখ্যমন্ত্রী অনুধাবন করেছেন দলের নেতা -কর্মী বিধায়ক পুরসভার চেয়ারম্যান, কাউন্সিলার অনেকেই অনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, যার ফলে মানুষের  ক্ষোভের প্রতিফলন নির্বাচনে পড়েছে৷

মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে সাধুবাদ৷ তাঁর কঠোর অবস্থানে হয়তো সাময়িকভাবে দুর্নীতির প্রকোপ কিছুটা কমবে, কিন্তু এই দুর্নীতির মূলচ্ছেদ করা এত সহজ নয়৷ কারণ এই দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে৷ শুধুমাত্র কিছু নেতা মন্ত্রী, চেয়ারম্যান কাউন্সিলরই এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তা নয়, এর নেপথ্য কারণগুলো খুঁজে বার করতে হবে৷ এই দুর্নীতির শিকড় কোন একটি রাজ্যের কোন একটি দলের নয়৷ বলা যায় বিদেশী শাসক ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে এই দুর্নীতিও উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে গেছে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন কপোট দেশ প্রেমিকদের হাতে৷ পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সংসদীয় গণতন্ত্রের ত্রুটি ও সাধারণ মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে অজ্ঞতা---এই ছিদ্রগুলি দিয়েই ভারতবর্ষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটছে৷ নেতা মন্ত্রী কাউন্সিলাররা দুর্নীতির দাগ৷ দুর্নীতির ছিদ্র বন্ধ না করে শুধু দাগ মুছে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না৷

দুর্নীতির অবাধ স্রোত বন্ধ করতে হলে সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠাময় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রিত অর্থনীতির খোল-নলচে পাল্টাতে হবে৷ প্রাউট নির্দেশিত পথে বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে স্থানীয় মানুষের হাতে আর্থিক ক্ষমতা তুলে দিতে হবে৷ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি দূর করতে হবে৷ সাধারণ মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চেতনা অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে৷ আকাশ জমিন অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে হবে, মানুষের হাতে ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ জীবন ধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি জোগাড় করতে পারে৷ তারপরেও দুর্নীতির অবাধ-স্রোতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসবে কিন্তু দুর্নীতির মূলচ্ছেদ হবে না৷

দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে চাই সৎনীতিবাদী আদর্শ মানুষ৷ আজকের রাজনীতিতে যার  বড়ই অভাব৷ কোন রাজনৈতিক দলই সৎ নীতিবাদী মানুষ গড়ার দিকে গুরুত্ব দেয় না৷ কারণ নির্বাচনে জনগণের আস্থা অপেক্ষা রাজনৈতিক দলগুলি অর্থশক্তি ও পেশীশক্তির  উপর নির্ভরশীল৷ তবু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজ দলের নেতা মন্ত্রীদের দিকে আঙুল তুলে যেভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয় যদিও তিনি দুর্নীতির মূলে পৌঁছতে পারবেন না৷ যে মূল উৎপাটন করতে না পারলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ-ঘটন সম্ভব নয়৷ কারণ পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক গণতন্ত্রে দুর্নীতিপরায়ণ নেতা-মন্ত্রীরাই পুঁজিপতি শোষকের প্রধান হাতিয়ার৷ এই পুঁজিপতি শোষকরাই দুর্নীতি ও রাজনীতিরও মূলে আছে৷