রাষ্ট্র ভাষার মত একটা বিতর্কমূলক বিষয়ের অবতারণা করা খুবই হঠকারিতার কাজ হয়েছে এতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য তো বাড়েই নি, বরং তার বৈপরীত্যে অনৈক্যের মাত্রা বহুলাংশে বেড়ে গেছে৷
কেউ কেউ আবার সমগ্র ভারতবর্ষের জন্যে একটি লিপি প্রবর্তনের কথা ভাবছেন৷ এটা কি আদৌ বৈবহারিক বা বাঞ্ছনীয়? সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুলিপি প্রবর্তনের পরিণাম কি তারা ভূলে গেছেন? (পাকিস্তানের ন্যাশানাল সেন্টিমেন্ট তবু তো ভারতের চেয়ে ঢের বেশী মজবুত ছিল)৷ যে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট রূপই পরিগ্রহ করেনি সেই ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কী-ই বা বলা যায়!
ভারতবর্ষ বহু লিপির দেশ ৷ প্রতিটি লিপি প্রায় সমান পুরানো৷ ভারতের সাধারণ সম্পত্তি সংস্কৃত অতি প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন লিপিতেই লিখিত হয়ে আসছে৷ সংস্কৃত লিপি বলে কোনো লিপি নেই৷ ভারতীয় বর্ণমালা alphabetical order) ধবনিবিজ্ঞান সম্মত হলেও বৈবহারিক ক্ষেত্রে লিপিগুলি বিজ্ঞানসম্মত নয়৷ রোমান লিপি বিজ্ঞানসম্মত হলেও ঢালাও ভাবে ভারতের প্রতিটি ভাষাতে ব্যবহার করা ক্ষতিকর৷যে সকল ভাষায় সাহিত্য বলতে কিছুই নেই (যেমন কোঙ্কনী,সাঁওতালী, খাসিয়া প্রভৃতি) অথবা যে ভাষা গুলি এখন জনগণের কথ্যভাষা নয় (যেমন সংস্কৃত, পালি) সেগুলোতে ও রোমান অক্ষর ব্যবহারে হয়তো কোন অসুবিধা হবে না৷ কিন্তু যেগুলি সাহিত্য-সমৃদ্ধ জীবিত ভাষা (যেমন বাংলা, হিন্দী, তামিল, গুজরাটী) সেগুলোতে রোমান অক্ষর ব্যবহার করলে ভাষাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ তাতে করে তাদের অতীতের সাহিত্যের সঙ্গে ভবিষ্যতের সাহিত্যের যোগসূত্র বিছিন্ন হয়ে যাবে৷ এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, কামাল পাশার সময় তুর্কি ভাষা যখন আরবী লিপি ছেড়ে রোমান লিপি গ্রহণ করেছিল বা মারাঠী ভাষা যখন ভাষা যখন মোড়ী লিপি বর্জন করে নাগরী লিপি গ্রহণ করেছিল তখন সাহিত্যের ব্যাপারে তারা ছিল খুব অনগ্রসর৷ আজকে মারাঠী বা তুর্কী পক্ষে লিপি পরিবর্তন করা রীতিমত ক্ষতিকর৷ কোথাও লিপিগত পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় কি না সে ব্যাপারটা সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষীদের স্বাধীন ইচ্ছার ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত৷
এ ব্যাপারে আরও একটা বড় সমস্যা রয়েছে৷ ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ও উর্দু ভারতীয় ও পাকিস্তানী দুই-ই বটে, সুতরাং তাদের লিপি পরিবর্তন করা কেবল ভারতবর্ষ বা কেবল পাকিস্তানের এক্তিয়ারের বাইরে৷ ভারতবর্ষে কেবলমাত্র বাংলা বা কেবলমাত্র উর্দু লিপি ব্যবহার করলেও সমস্যার সমাধান হবে না যদি না পাকিস্তান ও মেনে নেয়৷ অন্যথায় কেবলমাত্র একটির রাষ্ট্রলিপি পরিবর্তন করলে ভাষাগুলি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ জনসাধারণ মাতৃভাষাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দিতে চাইবে না ৷ তারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠবে--- যেমনটি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় উর্দু লিপি চালানোর প্রচেষ্টার প্রতিবাদে৷ যে কল্পনায় অশান্তির সম্ভাবনা থাকে তাকে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া কি বিবেচকের কাজ? নেতৃবৃন্দ কল্পনার নেশা ছেড়ে দিয়ে বাস্তবের মাটিতে নেমে দেখুন--- বাস্তবের মাটি খুবই কঠোর, খুবই নিষ্করুণ৷
উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রায় সর্বত্রই আজকাল স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ইংরেজ আমলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজী৷ ভারতের যে কোন প্রান্তের ছাত্র যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ইংরেজীর মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করতে পারত৷ কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয়েগুলিতে বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রদের পারস্পরিক মেলামেশার ফলে একটি সর্বভারতীয় ভাতৃত্ববোধ জেগে উঠত৷ কিন্তু আজ স্থানীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার ফলে বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রদের মেলামেশার সুযোগ যাচ্ছে কমে৷ সর্বভারতীয় বোধ জাগবার অবকাশ ক্রমশঃ হয়ে যাচ্ছে সঙ্কুচিত৷ ছাত্ররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকায় প্রদেশের ইজম ক্রমশঃ তাদের পেয়ে বসেছে৷ বড় বড় নেতারা তাদের ইজম্গুলোর নিন্দা করছে কিন্তু ইজম্গুলো থেকে তাদের দূরে রাখবার কোন বাস্তবোচিত পন্থা নিচ্ছে না৷ (ক্রমশঃ)