রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিকৃতি প্রতিবাদে সমস্ত বাঙালী এক হোন

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

‘সংস্কৃতি একটি জনগোষ্ঠীর সসম্মানে বেঁচে থাকার অন্যতম হাতিয়ার৷ আজ বাঙলার সাংস্কৃতিক জগতে চরম হিন্দী আগ্রাসন চালানোর ফলে বাঙলা তার উৎকর্ষতা ও শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে ফেলে মানসিক শোষণের চাপে দিশেহারা৷ এই সুযোগে বাঙলার প্রাকৃতিক, খনিজ, বনজ সম্পদকে বাঙলার বাইরে পাচার করা হচ্ছে৷ সবই ঘটছে আমাদের চোখের সামনে কিন্তু আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না৷ এই না দেখার কারণটা হল আমাদের চোখের সামনে হিন্দীর ললিপপ রাখা রয়েছে, তা ললিপপের লোভেই আমাদের সর্বশান্ত করে দিচ্ছে দেশীয় পুঁজিবাদী৷ যে উন্নত রুচিশীল ভাষা সভ্যতার জোরে বাঙলা নিজস্ব চিন্তাধারা বজায় রেখে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই বাঙালীই আজ শোষণে পর্যুদস্ত, বহিরাগতদের পদতলের আজ্ঞাবহ দাস!

টি.ভি সিরিয়াল, বাংলা সিনেমা সর্বত্রই হিন্দী গান, নোংরা ভোগ সর্বস্ব হিন্দী সংস্কৃতির আদলে তৈরী সংস্কৃতির প্রচার চালানো হচ্ছে৷ এতে একদিকে বাঙালীর শিল্পসত্ত্বা ধবংস হচ্ছে অন্যদিকে শোষণের বিরুদ্ধে একদা যে সাহিত্য-সঙ্গীত গণবিদ্রোহ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল তা থেকে রেহাই মিলছে৷ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দেমাতরম্‌’ গান কিংবা দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’, শরৎচন্দ্র  চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ কিভাবে ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে  দেশের মানুষের মূলত যুবক শ্রেণীর মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণরোষ জাগিয়ে তুলে তা আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি৷ বর্তমানে বাঙালী যুবক শ্রেণীর মননে প্রচার মাধ্যম কি জাগাচ্ছে? মদ খাও, পার্টি কর৷ বাঙলার রীতিতে কারোয়াচৎ, মেহেন্দি নামক বিবাহ অনুষ্ঠান এসব ছিল না৷ বাঙালী নারীরা বিশেষ সন্মানে পুজিত হতেন বাঙলায় কিন্তু এখন? টিভি সিরিয়াল, সিনেমাগুলি হিন্দী নোংরা সংস্কৃতির  ধাচে বাংলাতে তা নির্মাণের ফলে নারী জাতি ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করা হচ্ছে৷ বর্তমান বাংলা টিভি সিরিয়াল, সিনেমা এগুলো বাঙলার যুবকশ্রেণী, নারী জাতির মনে ভোগ সর্বস্ব মানসিকতা জাগাচ্ছে তাই বিদ্রোহও পালাচ্ছে৷ এটা বুঝে গেছে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ৷ কেউ মনে করতে পারেন অনেক ভালো হিন্দী গান আছে, সেগুলি চালালে ক্ষতি কোথায়? তাদের কাছে আমার প্রশ্ণ হিন্দী সিরিয়াল, গানের শোতে একটিও বাংলা  গান চালানো বা বাংলার সংস্কৃতি দেখানো হয় কি? অবশ্যই নয়৷ একথা অনস্বীকার্য বাংলা - সংস্কৃতি - সঙ্গীত বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম অংশ, তা সত্ত্বেও শুধু বাঙলা ও অহিন্দীভাষী রাজ্যগুলির সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দীর রাজ কায়েম হচ্ছে কেন? এছাড়াও ভারতবর্ষে তো শুধু হিন্দী নয় বাংলা ছাড়াও মৈথিলী, অঙ্গিকা, মারাঠি, ওড়িয়ার মত উন্নত  ভাষা সংস্কৃতি আছে, তা হলে পরিচালকেরা কেন শুধু হিন্দী সংস্কৃতির প্রচার চালাচ্ছে? এদের পেছনে আছে অবাঙালী পুঁজিপতি প্রডিউসার৷ এদের উদ্দেশ্যটাই হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে হিন্দি চাপানো ও বাঙালীর মননে বাঙলা ভাষা সম্পর্কে অবজ্ঞা ভাব তৈরী করে এক মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত করা৷

লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন! কলকাতার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে ২৯তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের  উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বলিউডি তারকাবৃন্দ সহ দর্শকদের সামনে রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ ঐতিহাসিক গানটি গাওয়ার সময়েই গানের শেষ দুটি স্তবকে ‘বাঙালির পণ’, বাঙালির আশা’ ও ‘বাঙালির মন’ অংশটিতে ‘বাঙালী’র পরিবর্তে ‘বাংলা’ করে গাওয়ানোয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের  বিকৃতি ও কবিগুরু তথা সমগ্র বাঙালী জাতির চরম অবমাননা করলেন৷

রবীন্দ্রগানের বিকৃতি বাঙলার বুদ্ধিজীবীদের শীতঘুম ভাঙাচ্ছে না কেন? কয়েক মাস আগে নবান্ন সভাঘরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত হিসেবে রবি ঠাকুরের ঐতিহাসিক ‘ বাঙলার মাটি বাঙলার জল’ গানটি ধার্য করার পর যখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ভোটের রাজনীতির চালে অবাঙালী তোষামোদের কথাটি মাথায় আসে তখন থেকেই তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রঠাকুর রচনায় কাঁচি চালিয়ে বলেছিলেন ‘বাঙালী’র পরিবর্তে ‘বাংলা’ ব্যবহার করলে অবাঙালীরা কষ্ট পাবে না! যদিও তখন নানা মহলের আপত্তি থাকায় সরকার এই সিদ্ধান্তে আসে যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিকৃতি করা হবে না, কথা পাল্টানো হবে না৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে আমরা দেখলাম নেতাজী ইন্ডোরে রবীন্দ্রগানের কথা পাল্টে বিকৃতি ঘটল৷ ছিঃ ছিঃ এ লজ্জা কবিগুরুর অপমান, সমগ্র বাঙালী জাতির অপমান৷ ২১০ সংখ্যকের উপর বিধায়ক নিয়ে মাননীয়া যেন নিজেকে ভগবান মনে না করেন৷ স্মরণ করানো দরকার, একটা সময় বামফ্রন্টের বিধায়ক সংখ্যা ছিল ২৩৫৷ আর এখন? শূন্য৷ অহমিকা পতনের মূল কারণ৷ মাননীয়া নিশ্চয়ই ভুলে যাননি ২০১৯ লোকসভা ভোটে অবাঙালী প্রাধান্য অঞ্চলগুলিতে হেরে বাঙালী বাঙালী করে ‘বাঙালী ভাবাবেগ’কে কাজে লাগিয়ে আবার ২০২১ বিধানসভা ভোটে জিতে সেই জায়গা পূরণ করেছে তৃণমূল সরকার৷ আজ ক্ষমতার আস্ফালনে যে সমস্ত অবাঙালীরা পঃবাঙলায় থেকে প্রতিনিয়ত বাঙালীদের অপমান, বাঙলার অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বাঙালীদের নিজভূমে কোনঠাসা করছে সেই অবাঙালীদের তোষণে মাননীয়া তাঁর নিজ জাতি বাঙালীদেরই অপমান করলেন৷ এটাকে মেনে নেওয়া সমগ্র  বাঙালীদের দূর্বলতার সমান, তাই আসুন অবিলম্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলি---‘বাঙলার মাটি, বাঙলার জল’ গান থেকে ‘বাঙালী’ বা অন্য কোন শব্দের কোন পরিবর্তন করা যাবে না, মূল রবীন্দ্রসঙ্গীতটিই গাইতে হবে৷ আজ এই চরম সাংস্কৃতিক অবক্ষয় থেকে বাঙলাকে বাঁচাতে রবি ঠাকুরের ভাষায় বলি, ‘বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান৷’ দল-বর্ণ-ধর্মমত সব কিছুর ঊধের্ব উঠে সমস্ত বাঙালী এক হোন৷