সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে জেগেছিল শিল্প সৃষ্টির এষণা ও প্রেষণা৷ এষণাই প্রেষণাকে ডেকে আনে৷ সভ্যতার প্রথম ধাপে শিল্পমাত্রই ছিল কুটির শিল্প৷ নারী–পুরুষ–বালক নির্বিশেষে সবাই শিল্প রচনায় হাত লাগাত৷ পরে দেখা গেল কিছুশিল্প গ্রামে গ্রামে করা যায় না.....করতে হয় কিছু সংখ্যক গ্রাম নিয়ে৷ তা না হলে তাদের একদিকে যেমন বাজারের ঘাটতি পড়ে, অন্যদিকে তেমনি শিল্পীর সংখ্যাতেও অভাব দেখা দেয়৷ তখন মানুষ প্রথম শিল্পায়োগ বা কারখানায়* যেতে শুরু করল৷ এখানে প্রসঙ্গতঃ একটা কথা বলে’ রাখি৷ শিল্প যত বেশী কুটীর–শিল্প হয়, শিল্প যত বিকেন্দ্রীকৃত হয়, মানুষের সুবিধা তত বেশী৷ এতে যে শুধু আর্থিক সামর্থ্যকে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় তাই–ই নয়, ধনের সর্বত্র মোটামুটি রকমের বন্টন হওয়ায় আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দেয় না৷ কোথাও অভাবের তাড়নায় মৃত্যুর হা–হা ধ্বনি, কোথাও প্রাচুর্যের স্ফীতিতে অনাচার কোনটাই বড় একটা হতে পারে না৷ শুধু কি তাই, বিকেন্দ্রীকৃত শিল্পে মানুষকে শিল্পায়োগে কাজ করবার জন্যে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে হয় না, যার ফলে বাইরে থাকার জন্যে দু’টো সংসারের খরচের হাত থেকে বাঁচা যায়৷ আবার কর্ম্মী সংগ্রহেরও সুযোগ পাওয়া যায়৷ একই মানুষ অর্থোপার্জন ও গৃহস্থালীর অন্যান্য কাজও করে’ থাকে৷ কিন্তু পুঁজিবাদী কাঠামোয় সেটা করা যায় না৷ পুঁজিবাদে সেটাকে সমর্থনও করা হয় না, কারণ পুঁজিবাদে শিল্পায়োগ মুনাফার জন্যে (production for profiteering) প্রাউটের বক্তব্য....... যে বক্তব্য প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষ স্বীকার করবেন –– পণ্যের উৎপাদন মানুষের প্রয়োজনে (production for consumption)৷ তাঁরা পুঁজিবাদীরা চান সস্তায় উৎপাদন, ও অধিক মূল্যে বিক্রয়৷ সস্তায় উৎপাদন করতে গেলে পরিবহন–যোগ্য নৈকট্য চাই, কাঁচামাল চাই, শক্তি চাই, সস্তায় শ্রমিক চাই, প্রয়োজনীয় জল চাই৷
তাই পুঁজিবাদ শিল্পে কেন্দ্রীকরণ চাইবেই –– তা সে পুঁজিবাদ বৈয়ষ্টিকই হোক, বা গোষ্ঠীগতই হোক৷ এই ধনতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে কলকাতা, মুম্বাই, আমেদাবাদ, দিল্লী, কানপুর, মাদ্রাজের কাছাকাছি জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে শত সহস্র শিল্পায়োগ৷ আর বীরভূমের খয়রাসোল, পুরুলিয়ার পুঞ্চা, আরামবাগের গোঘাট ও ন’দের নাকাশিপাড়া অন্ধকারের চামচিকার মত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে রয়েছে৷ ওই জায়গাগুলির নামও হয়তো অনেকে শোণনি, শুণবেই বা কী করে? ওখানকার মানুষেরা ভীষণ গরীব, শীতের দিনে পশমী কোট–প্যান্ট তো দূরেরকথা, অনেকের আলোয়ানও জোটে না৷ কম্যুনিজম্ হচ্ছে রাষ্ট্রীক পুঁজিবাদ৷ তাই পুঁজিবাদের দোষগুলি থেকে কম্যুনিজমও মোটেই মুক্ত নয়৷ বৈয়ষ্টিকও গোষ্ঠীগত পুঁজিবাদেরমতই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রিকসত্তার দ্বারা পরিচালিত শিল্পায়োগ, অর্থাৎ রাষ্ট্রিক পুঁজিবাদে যেমন শিল্পায়োগ কেন্দ্রীকৃত হয়, রাষ্ট্রিক পুঁজিবাদের পরিপোষক কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রেও তেমনি কেন্দ্রীকৃত পুঁজিবাদকে সমর্থন করা হয়৷ তাই তত্ত্বগত বিচারে বৈয়ষ্টিক মুক্তির প্রশ্নে কম্যুনিজমের সঙ্গে ধনতান্ত্রিকতা বা পুঁজিবাদে কিছুটা লোক দেখানো বা খোসা–খোলার পার্থক্য থাকলেও, ভেতরের আঁটিটি দু–য়েরই এক৷ দুই–ই একই পুঁজিবাদের পোঁ–ধরা৷ মানুষকে যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মুক্তির আশ্বাস দিতে হয়, তাহলে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ করতেই হবে৷
গ্রাম–ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়তে যদি সাময়িক অসুবিধা থেকেও থাকে, তবু উপভুক্তি–ভিত্তিক •block-level— অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরী করায় এমন কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷ যে শিল্পায়োগ স্থাপনায়, পরিচালনায় তথা ভোগ্য বন্টনে উপভুক্তি ভিত্তিতে গড়তে একান্ত ভাবে অসুবিধাজনক –– কেবল সেগুলিই বৃহত্তর পরিভূতে করা যেতে পারে৷ যেমন ইস্পাতের কারখানা গ্রামে গ্রামে,ব্লকে ব্লকে, জেলায় না করে’ একটা বৃহত্তর পরিভূতে করলে সুবিধাজনক৷ এমন কিছু কিছু প্রগ্রহ শিল্প •Key industry— আছে, যার পরিচালনা ক্ষুদ্র পরিভূতে বা সমবায়ের দ্বারা হওয়া একটু অসুবিধাজনক৷ সেগুলিকে রাষ্ট্রিক পরিচালনাতেই করতে হবে৷ একটু বৃহত্তর পরিভূতেই করতে হবে৷ তবে এই বৃহত্তর পরিভূতে পরিচালিত প্রগ্রহ শিল্পকে ধনতান্ত্রিকের হাতে ছাড়া সম্ভব নয়, কারণ তাতে জনগণের প্রয়োজন পূর্ণভাবে না হোক আংশিকভাবে অস্বীকৃত থেকেই যাবে৷ ধনতান্ত্রিকের হাতে ছেড়ে দিলে যেমন অসুবিধা তেমনিক সেই সকল ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পকারখানায় ছোট বড় নানান রকম ঝামেলা থাকায় সমবায়ের দ্বারা (সেগুলির) পরিচালনায় অসুবিধা দেখা যেতে পারে৷ কেবল সেই অতি বৃহৎ শিল্পগুলি রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় থাকবে৷ তাকে বিকেন্দ্রীকরণ না করে’ কেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে ৷ তবে যাকে আজ বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভবপর নয় বলে’ মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে পরিবর্ত্তিত পরিস্থিতিতে তাকেও হয়তো বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব হবে৷ তখন তাকে তাই–ই করতেহবে৷ কেন্দ্রীকৃত শিল্পে আরও অনেক অসুবিধা রয়েছে৷ যেমন– কেন্দ্রীকৃত শিল্পে মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে৷ তাজা ফলমূল, শাকসব্জী, দুধের অভাব, নৈতিক অনাচার, চোর–ডাকাত–সমাজবিরোধীদেরলুকিয়ে থাকার আস্তানা, নেশাগ্রস্তদের ভীড়–ভাড়াক্কা, পাপাচারীদের কৃষ্ণ গহ্বর, ওজনের অভাব, বায়ু বিদূষণ, জল বিদূষণ .....আর কত বলি৷
৬ নভেম্বর ১৯৮৮, কলিকাতা
(শব্দচয়নিকা ঊনবিংশ খণ্ড –– প্রবচন ১৪৮)