পূর্ব প্রকাকশিতের পর
আমাদের বক্তব্য হ’ল, মানুষকে নীচ করে, মানবতাকে অবহেলা করে, তাকে কখনও শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ শাস্ত্র তৈরী করে মানুষ নিজের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্যে৷ শাস্ত্র শাসন করবে নিশ্চয়ই, কিন্তু সে শাসন কখনও মানুষকে কবর দেবার জন্যে নয়৷ মানুষকে তার ন্ধন থেকে মুক্ত করে সবার উৎস সেই পরম সত্তার সাথে মিলিয়ে দেওয়াতেই শাস্ত্রের সার্থকতা৷ শাস্ত্র মানুষের টুঁটি টিপে হত্যা করবে, শুধু বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে জীবনের স্বাভাবিক গতিটুকুকে রুদ্ধ করে দেবে---মানুষের সমাজে তা কখনও সমর্থন করা যায় না৷
পাপপুণ্যের ধারণা বিভিন্ন মানুষের খামখেয়ালীর ওপর ভিত্তি না করে ? হওয়া দরকার৷ মানুষকে যেতে হবে এমন এক স্তরে যেখানে গিয়ে তাকে আর এগিয়ে যাবার প্রশ্ণ থাকে না৷ যে কম তথা সমষ্টি এই ক্রবাভাবিক গতির বিরোধিতা করে, তা-ই পাপ৷ আর যে কর্ম মানুষ তথা সমাজকে এই যাত্রাপথে সহযোগিতা করে সেই কর্মকে ল পুণ্যকর্ম৷ ব্যষ্টি বা দলগত স্বার্থের প্ররোচনায় অন্য কোন ব্যষ্টি, দল বা অবশিষ্ট সমাজকে শোষণ করা বা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যে যা কিছু কর্ম করা হয় তা সবই পাপ৷ এর জন্যে শাস্তিবিধান নিশ্চয়ই করতে কিন্তু পাপের শাস্তি কখনও মানুষের প্রাণ-হত্যায় নয় বা তাকে চিরতরে ক্ষতি করবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার নয়৷ কারণ তা করতে গিয়ে শোষণের জন্যে৷ পণ্ডসংহিতার তাই ভিত্তি হবে মানবিক মূল্য৷ আমাদের আজ-শাস্ত্রে শাস্তি সম্পর্কে লেখা হয়েছে---‘‘অপরাধীকে প্রথমে মিষ্টকথায় বোঝাবে৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে তাকে কঠোর ভাবে বােঝাবে, তৃতীয় পর্যায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা লবে, চতুর্থ পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নেবে৷’’ এইভাবে শাস্তিবিধান করার মূলে রয়েচে মানবিক আবেদন৷ মানুষ পাক করে অনেক কারণে৷ কিন্তু তাকে সুযোগ দিতে হবে শোধরানোর৷ যদি সে নিজের দোষকে ঝতে না পারে তবে তাকে বােঝাতে হবে৷ না ঝলে তবেই সে শাস্তি পাবার যোগ্য৷ তাছাড়া শাস্তি অপরাধীকেই দেওয়া হবে, তার পরিবারের অন্য কোন লোককে নয়৷ ত্রুটি সংশোধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শাস্তি প্রত্যাহার করা হবে৷ কেউ পাপ করেছে বলে তার সারা জীবন নষ্ট হতে দেওয়ার সুযোগ যেন না দেওয়া হয়৷ কোন অবস্থাতেই কাউকে সমাজচ্যুত করা চলবে না৷
দেবালয়ের অন্ধকারে বসে পাথরের নারায়ণকে পূজা করতে গিয়ে দরিদ্রররররর-নারায়ণকে যারা অবহেলা করে তাদের ইহজীবন ও পরজীবনের পাওনার অঙ্ক তো শূন্যই, কারণ পরমাত্মার শ্রেষ্ঠরূপ মানববিগ্রহের অবমাননাযে তাঁরই অপমান৷ প্রকৃত ধার্িক এই তথ্যটি ভালোভাবেই জানেন যে নদবতা মন্দিরের নয়, মানুষের মধ্যে তাঁর মৃত্যু প্রকাশ৷
‘‘অন্ধকারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে,
নয়ন মেলে দেখ্ দেখি তুই চেয়ে
দেবতা নাই ঘরে৷
তিনি আছেন যেখায় মাটি ভেঙ্গে
করছে চাষা চাষ
পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ
খাটছে বারমাস৷’’ ---(রবীন্দ্রনাথ)
বিপ্রযুগে মানুষের মধ্যে উচ্চ-নীচ ভাবনার সৃষ্টি করে মানুষকে কত না অপমান করা হয়েছে৷ তথাকথিত নীচ জাতের ছোঁয়া লাগালে উচ্চ শ্রেণীর লোকেদের জাত যেত শুধু তাইনয়, নীচু জাতের ছায়াকে স্পর্শ করলেও বেদজ্ঞ বাহ্মণকে সমাজ থেকে বিদ্যুত হতে হ’ত৷ মানুষের প্রতি এত ড় ঘৃণা, এত তীব্র অবমাননা, আর কোন যুগে হয়নি৷ রবীন্দ্রনাথ এদেরই উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন---
‘‘মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে৷
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে৷৷’’
সদ্বিপ্ররা তাই কখনও কোনও মানুষকে ঘৃণা করবে না৷ প্রত্যেক মানুষকেই তার জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে’ তুলতে উৎসাহ দেবে৷ সদ্বিপ্রদের এটাই হবে প্রধান কর্তব্য৷ যেন কেউ কোনও অবস্থাতেই ভাববার সুযোগ না পায় যে তার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে৷ (ক্রমশঃ)