সদবিপ্রের নয়া মানবতাবাদ
সদ্বিপ্রের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য আর স কিছু মূল্যকেই অতিক্রম করে যায়৷ রাষ্ট্রই হোক আর শাস্ত্রই হোক, সমাজ হোক আর ধর্মই হোক সবকিছুর সার্থকতা আছে মানুষের জ্ঞানের মধ্যে, সংস্কৃতির মধ্যে, স্বাস্থ্যের মধ্যে, জীবনের প্রাচুর্যের মধ্যে, মনুষ্যত্বকে পরিপূর্ণ মহিমায় বিকশিত করে তোলার মধ্যে৷ মানুষকে বিকশিত করে তোলার জন্যে সভ্যতার সমস্ত উপকরণ রাষ্ট্রের যত বিচিত্র রূপ, মতবাদের যত বৈচিত্র্য, যত বিধিনিষেধ, শাস্ত্রের যত অনুশাসন, মানুষ যদি আত্মপ্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল, তার দেহ যদি স্বাস্থ্যে সবল, বুদ্ধি যদি জ্ঞানে সতেজ ও হৃদয় যদি প্রেমে বিশাল হার সুযোগ না পেল, তবে কিসের জন্যে রাষ্ট্রের ইমারত, কিসের জন্যে বিধিব্যবস্থা, কিসের জন্যে সভ্যতার এত সাজ সরঞ্জাম? রাষ্ট্র যদি জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছবার পথে সহায়ক না হয়ে অন্তরায় হয়, তবে সে মানুষের আনুগত্যের ওপর কোন দাবীই করতে পারে না, কারণ, মানুষ রাষ্ট্রের চেয়ে বড়৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘মানুষের পরিবর্তে বিচার ও আইন, রুটির পরিবর্তে পাথর৷ সে পাথর দুর্লভ ও মূল্যবান হতে পারে কিন্তু তাতে ক্ষুধা দূর হয় না৷’
সামাজিক মূল্যকে মানবিক মূল্যের থেকে বড় করে দেখা হ’ল আজ পর্যন্ত চিরাচরিত প্রথা৷ সদ্বিপ্ররা এই প্রচলিত রীতির মূলে কুঠারাঘাত করতে চায়৷ তাঁদের কাছে Human Value Precedes Social Value— মানুষের মূল্যকে সামাজিক মূল্যের আগে স্থান দিতে হবে৷ মানুষ নিয়ে সমাজ৷ এই সামাজিক মূল্য মানবিক মূল্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে অর্থাৎ সামাজিক মূল্য তাদেরই প্রাপ্য হওে যারা মানবিক মূল্যকে সম্মান কবে৷ প্রথমেই বলা হয়েছে---মানবিক মূল্য মানে হ’ল মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশাকে সহানুভূতির চোখে দেখে তাকে প্রজ্ঞাঘন চৈতন্যের সাথে মিশিয়ে দিয়ে দেবত্বের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা৷ এই দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে---তার দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক---এই তিন ক্ষেত্রেই উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করতে হবে৷ প্রতিটি মানুষের দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিকশিত হওয়ার জন্মগত অধিকার রয়েছে৷ সমাজের তাই কর্তব্য---মানুষের এই অধিকারকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া৷ সমাজ এই স্বীকৃতি দেয়নি লেই মানুষের জীবনে এত হাহাকার আজ যাকে আমরা ঘৃণা করছি, যে সমস্ত বখে-যাওয়া ছেলেগুলোকে আজ তাচ্ছিল্য করছি, তাদের যদি সমাজ সুযোগ দিত, তবে, তাদের মধ্য থেকেই যে মহান মনীষীর আবির্ভাব হ’ত না তা কে বলতে পারে? যে নারী আজ পেটের দায়ে গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করেছে, সমাজ যদি তাদের অন্তরের ব্যথাকে অনুভব করে বাঁচার মত চবার ব্যবস্থা করে দিত, তবে কে জানে তাদের মধ্য থেকেই হয়তো মহান ব্যষ্টিত্বের জননীকে আমরা দেখতে পেতুম৷ কিন্তু আজ সমাজে মানবিক মূল্যের স্বীকৃতি নেই লেই কত মহান ব্যষ্টিত্ব অঙ্কুরেই শুকিয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ছে ধূলার ধরণীতে৷ সদ্বিপ্রেরা সেই ভূলুণ্ঠিত মানবতার নবোত্থানের সূত্রপাত কবে৷ এদের কাছে কেউ পাপী লে ঘৃণ্য নয়, এরা কাউকে শয়তান লতে পারে না৷ মানুষ শয়তান হয়, পাপী হয় তখন যখন উপযুক্ত পরিচালনা পথনির্দেশনার অভাবে সে তার কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় কাজ করে ফেলে৷ ‘Human mind goaded by depraving propensities is Satan’ যদি তার এই কু-প্রবৃত্তিগুলোকে সু-প্রবৃত্তির দিকে প্রবাহিত করিয়ে দেওয়া যায় তখন সে আর শয়তান থাকবে না, সে তখন দেবতাতে রূপান্তরিত হবে৷ প্রত্যেকটি মানুষ হ’ল দেবশিশু---Men are divine children—এই তত্ত্বটিকে মনে রেখে সমাজের প্রত্যেকটি কর্মপদ্ধতির বিচার করা উচিত৷
সদ্বিপ্রেরা তাই যে অপরাধ-সংহিতা বা দণ্ড-সংহিতা তৈরী কবে, তাতে মানুষকে শাস্তি দেওয়া নয়, সংশোধন করাই হবে উদ্দেশ্য৷ কারাগার তৈরী না করে তারা করবে সংশোধনাগার৷ যারা জন্মগত কারণে অপরাধী নয়, যারা বৃত্তিগত ত্রুটির জন্যে অন্যায় করে ফেলে তাদের সেই ত্রুটি দূর করে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে৷ যারা অভাবের তাড়নায় অপরাধ করে, তাদের অভাব দূর করে দিতে হবে৷ সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে চলার মধ্যেই সমাজের সার্থকতা৷ কেউ যদি যাত্রাপথে পেছিয়ে পড়ে, গভীর রাত্রির তমিস্রায় দমকা হাওয়ায় যদি কারও দীপ নিবে যায় তা তাকে অন্ধকারের মধ্যে একলাটি ফেলে দিয়ে চলে গেলে তো চলবে না, তার হাত ধরে তুলে নিতে হবে, নিজের প্রদীপের আলোয় জ্বালিয়ে দিতে হবে তার নিভে-যাওয়া দীপকের শিখাকে ঃ
‘‘বর্ত্তিকা লইয়া হাতে
চলেছিল একসাথে
পথে নিভে গেছে আলো পড়ে আছে তাই৷
তোমরা কি দয়া করে
তুলিবে না হাত ধরে
অর্ধদণ্ড তার তরে থামিবে না ভাই?’’
---নিশ্চয়ই থামতে হবে কারণ তা না করলে সমাজের মূল সুরটির কোন দাম থাকে না৷ ঋষি বলেছেন, ‘‘সমমন্ত্রেন জায়তে ইতি সমাজঃ৷’’ তাই পাপী, তাপী, চোর, চরিত্রহীন, অপরাধী---যে কেউ হোক না কেন, এগুলো তার বাইরের পরিচয়৷ ভেতরে সে পবিত্র হওয়ার সম্ভাবনায় ভরপুর৷ সেই সম্ভাবনার উদ্বোধন করাই সদ্বিপ্রদের ব্রত৷ তারা মানবিক মূল্যপ্রদানে কখনও বাচবিচার কবে না৷ অতি ঘৃণ্য কাজ করার জন্যে, শাস্তি তার নিশ্চয়ই হবে কিন্তু তাকে ঘৃণা না করে না খেতে দিয়ে শুকিয়ে মেরে ফেলা মানবতাবাদী সদ্বিপ্রদের দ্বারা কখনও হয়ে উঠবে না৷ রোগগ্রস্ত যন হরিদাসকে শুশ্রূষা করার পবিত্র কর্তব্যটুকু পালন না করে সমাজ-নেতারা (?) তাদের পুঁথি আঁকড়ে পড়ে থাকতে পেরেছেন কিন্তু মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি৷ তিনি তাঁকে নিজের কোলে নিয়ে শুশ্রূষা করে মানবিক মূল্যকে শ্রদ্ধা করেছেন৷
কিন্তু সামাজিক দায়িত্বের যখন প্রশ্ণ আসবে, তখন নিশ্চয়ই নিখুঁতভাবে বিচার করে দেখতে হবে৷ যাকে তাকে সামাজিক দায়িত্ব দেওয়া চলবে না৷ কারণ সামাজিক দায়িত্ব যারা নেবে তারাই দেখাবে মানুষকে বিকাশের পথ, তারাই না পাপীদের সংশোধনের ভার নেবে৷ কিন্তু তারা নিজেরাই যদি কলুষিত মানসিকতা নিয়ে কাজ করে তবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না৷ সমাজ সম্পর্কে লা হয়েছে---নীতিবাদের প্রথম স্ফূরণ থেকে বিশ্বমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা---এই দুইয়ের মাঝে যে ব্যবধান রয়েছে সে ব্যবধানকে অতিক্রম করার কাজে যারা ব্রতী হয়েছে তাদের মিলিত গোষ্ঠীর নাম সমাজ৷ সুতরাং সামাজিক দায়িত্ব তাদেরই দিতে হবে যারা এই মহান কার্য সমাধা করতে সক্ষম৷ সমাজ যদি নীতিবাদ থেকে যাত্রা শুরু করে, তবে সমাজের ভার যারা নেবে তাদের অতি অবশ্যই হতে হবে নীতিবাদী৷ সমাজের পরিণতি যখন বিশ্বমানবতাবাদে প্রতিষ্ঠা, তখন তাদেরও হতে হবে বিশ্বজনীন৷ আর এই নীতিবাদ থেকে বিশ্বমানবতাবাদের ব্যবধানকে জয় করতে হলে যে পথ অবলম্বন করতে হয় তা হ’ল আধ্যাত্মিক সাধনার ন্দ্রথ৷ তাই তাদেরও হতে হবে কঠোর সাধনায় ব্রতী৷ তাই তাদের জীবনের দিগ্দর্শন হবে---Morality is the base, Sadhana is the means and Life Divine is the goal. এই মহান দায়িত্ব কখনও অপরাধপ্রবণ ব্যষ্টিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না৷ এরা যতদিন না নিজেদের সংশোধন করে নিচ্ছে ততদিন মানবিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে না নিশ্চয়ই কিন্তু কোন সামাজিক মূল্য এঁদের দেওয়া হবে না৷ বর্তমান সমাজে সামাজিক মূল্যকে সম্মান করা হয় টে কিন্তু সামাজিক দায়িত্ব নেবার জন্যে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের কারুরই উপরি-উক্ত গুণাবলী নেই৷ টাকার গরমে, সুপারিশের জোরে এক একটা পদ ওরা ব্যবস্থা করে নিয়েছে সত্য, কিন্তু এতে সামূহিক কল্যাণ সম্ভব হয়নি৷ তাই আমাদের সমাজ-শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে---কারুর লম্বা -চওড়া বক্তৃতায় মানুষ যেন না ভুলে, কাজ দেখে যোগ্যতা বিচার করতে হবে৷ যে যে অবস্থায় রয়েছে তার সেই অবস্থাতেই সমাজ-সেবা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে৷ যার স্বভাব যমনিয়ম-বিরোধী তাদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ যেন না দেওয়া হয়৷ অযোগ্য ব্যষ্টির হাতে ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ, জেনে শুণে সমাজকে ধবংসের দিকে ঠেলে দেওয়া৷ সদ্বিপ্রেরা যোগ্য ব্যষ্টিকে সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত কবে ও এই যোগ্য ব্যষ্টিদের দ্বারা যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে সে সমাজ মানুষকে তার যথাযথ মূল্য দেবে৷ সেই সমাজই হবে সুষ্ঠু সমাজ৷ এই নয়া মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নোতুন সমাজে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ খঁুজে পাবে েঁচে থাকার পরম সার্থকতা৷ মানুষ প্রতিষ্ঠিত হবে তার হারানো সম্মানের আসনে৷