১৭তম লোকসভা নির্বাচনী পর্ব অতি সম্প্রতি শেষ হ’ল৷ এই সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত কেবল বোট গণনা বাকী রয়েছে৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তাদের সমীক্ষায় বিজেপির ক্ষমতায় ফিরে আসার সংকেত দিয়েছে৷ বিরোধীরা একে বিজেপির সূক্ষ্ম কৌশল বলে প্রচার করছে৷ তাদের দাবী, এইভাবে জনমনে বিজেপির জেতার সম্ভাবনার হাওয়া তুলে ই.বি.এম. মেশিনে কারচুপি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ যাইহোক, ২৩ তারিখেই বোটের রেজাল্ট জানা যাবে৷
কিন্তু বর্তমানে আমরা একটা সমীক্ষা করে দেখতে পাই, এই যে বিশাল নির্বাচনী রাজসূয় যজ্ঞ যাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের মহান অবদানের কথা বলা হচ্ছে, তা কি সত্য-সত্যই তার মর্যাদা রেখেছে? এই গণতন্ত্র কী জনগণের যথার্থ আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করতে পেরেছে?
প্রথম কথা বলি, এই নির্বাচনে কালো টাকার ভূমিকা নিয়ে৷ গণতন্ত্রের আদর্শ হ’ল, জনগণ স্বাধীনভাবে বিচার-বিবেচনা করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবে, যারা সরকার গড়ে তাদের স্বার্থ দেখবে৷ অর্থাৎ তারা সর্বপ্রথম দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান করবে, দেশে ন্যায় ও শান্তি বজায় রাখার ব্যবস্থা করবে, নির্বাচনের ক্ষেত্রে কালো টাকা ও পেশী শক্তি কোনওভাবে প্রভাব বিস্তার করবে না বা অন্য কোনও অনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড জনসাধারণের স্বাধীন মতামত প্রকাশকে বিঘ্নিত করবে না৷
কিন্তু, দেখা যায়, এই গোড়াতেই গলদ৷ নির্বাচনে কালো টাকা, পেশীশক্তি, নেতা-নেত্রীদের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উক্তি, বিকৃত তথ্য ও ভুয়া প্রতিশ্রুতি সরল অশিক্ষিত জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে অবাধে বোট লুণ্ঠন ক্রিয়া চালাতে থাকে৷ এবারে নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালে নির্বাচনে কালো টাকার খেলা বন্ধ করার জন্যে পুলিশ ও আয়কর বিভাগের আধিকারিকদের নিয়ে ফ্লাইং স্কোয়াড টীম তৈরী করা হয়েছিল৷ ওই ফ্লাইং স্কোয়াড টীম গত ১০ই মার্চ, যেদিন লোকসভা নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারী হয়েছিল সেদিন থেকে গত ১৭ই মে পর্যন্ত ৬৬.৮৩ কোটি কালো টাকা উদ্ধার করে৷ অর্থাৎ এই টাকাটা নির্বাচকমণ্ডলীকে ঘুষ দেওয়ার জন্যে যাচ্ছিল বলে নির্বাচন কমিশনারের অনুমান৷ আর এটাই স্বাভাবিক৷ তার মানে সব কালো টাকাই উদ্ধার হয়েছে---তা ভাববার কোনও কারণ নেই৷ সমুদ্রে ডুবে থাকা বিশাল হিমশৈলের সামান্য একটু যেমন চোখে পড়ে, এও তাই৷ এই নির্বাচনে কালো টাকার খেলা যে খুব কম হয়েছে তা নয়, সামান্য কিছু টাকা বিলি করার আগেই ধরা পড়েছে মাত্র৷
টাকার পাশাপাশি সাধারণ বোটারদের মধ্যে প্রার্থীদের তরফ থেকে তাদের মন জয় করতে দেদার মদ বিলিও হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৬ লক্ষ ২৬ হাজার লিটার মদ-ও উদ্ধার করা হয়েছে৷ যা রেকর্ড৷
তারপর পার্টিগুলি জনসাধারণের কাছে তাদের নীতি ও কার্যাবলী প্রচারের চেয়ে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি ও জাত-পাতের সেণ্টিমেণ্টকে বেশী কাজে লাগিয়েছে৷ নির্বাচনী বত্তৃণতাগুলিতেই দেখা গেছে নেতা-নেত্রীরা জঘন্য ধরণের গালিগালাজেি বেশী করে মেতে উঠেছিল, যেটা সুস্থ প্রচারে একেবারেই কাম্য নয়৷ দেশে প্রত্যেকের খেয়েপরে বাঁচার অধিকার রয়েছে৷ প্রত্যেকের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গ্যারাণ্টি পাওয়ার অধিকার রয়েছে৷ উত্তরোত্তর ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিরও অধিকার রয়েছে৷ কিন্তু যোগ্যতার বিচার না করে কাউকে কোনকিছু দায়িত্ব দেওয়া অনুচিত৷ বিশেষ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যে সমস্ত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দেওয়া হবে , তাদের অবশ্যই নীতিবাদী সমাজ-সচেতন হতে হবে ও সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে৷ নাহলে তারা দেশ চালাবেন কেমন করে?দেশের জন্যে আইন প্রনয়ণ করবেন কেমন করে? সাংসদদের হাতেই তো দেশের বিভিন্ন বিভাগের আইন প্রণয়নের ভার থাকে৷ এই সমস্ত যোগ্যতা যাঁদের নেই, সেই সমস্ত মানুষদের জনপ্রতিনিধি করা কি পরিহাসমূলক নয়? এবারে দেখা গেছে অনেক প্রার্থী আছেন যাদের মাধ্যমিক পর্যন্তও পড়াশুনা নেই, অনেকে আছেন যাঁদের বিরুদ্ধে বহু অপরাধমূলক অভিযোগ আছে৷ এসব নিসন্দেহে গণতন্ত্রের নামে প্রহসন৷ সর্বোপরি জনপ্রতিনিধিকে কঠোরভাবে নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যা তার জীবনের বিভিন্ন কাজকর্মেই প্রকাশ পাবে৷ প্রাউট প্রবক্তা এই ধরণের চরিত্রের মানুষকে বলেছেন সদ্বিপ্র৷ বস্তুতঃ ‘সদ্বিপ্র’ চরিত্রের মানুষ না হলে জনপ্রতিনিধি কাউকেই হতে দেওয়া উচিত নয়৷ যারা সদ্বিপ্র চরিত্রের নয়, তারা শাসন ক্ষমতা হাতে পেলে জনগণের সেবার নামে জনগণকে শোষণই করবেন৷ তারা বর্তমান প্রচলিত সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের পরিবর্তে পুঁজিবাদীদেরই স্বার্থরক্ষা করবেন৷
- Log in to post comments