অ-শান্তিনিকেতন!

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

প্রাচীন ভারতের তপোবনের অধ্যাত্ম-ভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার যোগসাধনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী স্থাপন করে ছিলেন৷ শুরুতে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম৷ প্রাচীন ভারতের মুনীঋষিদের আদর্শকে তিনি এই শিক্ষার ভিতরূপে গ্রহণ করেছিলেন৷ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার দিবসেই তিনি তাঁর আদর্শ পরিষ্কার ভাবে সুপরিস্ফুট করেছিলেন৷ তিনি প্রাচীন ভারতের ঋষিদের আদর্শের মূল কথাকে তুলে ধরে বলেছিলেন,‘‘তাদের বেশভূষা বিলাসিতা কিছুই ছিল না৷ অথচ বড়ো বড়ো রাজারা এসে তাঁদের কাছে মাথা নত করতেন৷... আমরা টাকাকড়ি জুতোছাতা পাবার জন্যে  যেরকম  প্রাণপণ খেটে মরি, তাঁরা সত্যকে পাবার জন্যে তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট স্বীকার করতেন৷ সেইজন্যে তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বড়ো ছিলেন৷ তাঁরা অভয় ছিলেন, ধর্ম (সার্বভৌম মানবধর্ম) ছাড়া আর কিছুকেই ভয় করতেন না৷ তাঁদের মনের মধ্যে এমন-একটা তেজ ছিল, সর্বদাই এমন একটি আনন্দ  ছিল, তাঁরা কোনো রাজা-মহারাজার অন্যায়  শাসনকে গ্রাহ্য করতেন না, এমনকি মৃত্যুকেও  তাঁরা ভয় করতেন না৷’’

এই সত্যানুসন্ধানের আদর্শ, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ যাকে তিনি বলেছেন মনুষত্বের পূর্ণত্ব লাভের সাধনা৷ তারই সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন আধুনিক সভ্যতার শিক্ষার বিভিন্ন শাখাকে ৷ তিনি চেয়েছিলেন, আধুনিক জড়বাদী তথা ভোগবাদী প্রভাবের মারাত্মক বিষ থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে৷ তিনি তাঁর এই আদর্শ তাঁর  বিভিন্ন রচনা ও প্রবন্ধাবলীতে সুস্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন৷ আর, বিদ্যালাভকে তিনি সাধনা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন৷ তিনি ভাবতেন তার উপযুক্ত স্থান নাগরিকতার কলুষ পরিবেশ নয়, তপোবনের স্নিগ্দ  পরিবেশ৷ তাই তিনি ক্লাসরূমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থার পরিবর্তে বৃক্ষতলে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন৷ গাছপালার প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাখীর কলতান, খোলামেলা পরিবেশই ছিল তাঁর পছন্দ৷ প্রকৃতিকে ইট, কাঠ দিয়ে একেবারে বেঁধে ফেলা নয়, খোলামেলা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা তিনি চাইতেন৷ নিরাপত্তার জন্যে ঘরবাড়ী তো চাইই, কিন্তু যতদূর সম্ভব প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্যে মহানগরী কলকাতার রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ থেকে বহুদূরে গিয়ে প্রকৃতির ঠিক কোলটিতে বসে তিনি উদ্দেশ্যসাধনে ব্রতী হয়েছিলেন৷

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শকে সমগ্র দেশের তথা বিশ্বের গুণীজন উচ্চপ্রশংসা করেছেন৷ বিশ্বভারতীর আলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে৷

রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বভারতীর আদর্শ যাতে ঠিক ঠিক ভাবে  রক্ষিত হয়, যাতে অর্থাভাবে একে ধুঁকতে না হয় এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার  এটির পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন৷

কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, এর আর্থিক দায়িত্ব যথাযথভাবে বহন করা ও যাতে রবীন্দ্র আদর্শ অনুরাগী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্‌গণ মিলে এই  বিশ্বভারতীর আদর্শের প্রদীপকে সযত্নে জ্বালিয়ে রাখেন তার দিকে  নিরপেক্ষভাবেই সতর্ক নজর রাখা৷ বর্তমানের ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ভিত্তিক কদর্য রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে কবিগুরুর এই মহান প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকল সরকার ও রবীন্দ্রানুরাগী বিদ্ব্যৎ সমাজ তথা জনগণের৷

কিন্তু বেশ কিছুদিন থেকে আমরা লক্ষ্য করছি সম্পূর্ণ দলীয় স্বার্থে বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা হচ্ছে৷ আর এই কাজে মদত দেবার জন্যে উপাচার্যের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল উঠছে৷ বছর খানেক আগে শান্তিনিকেতনের অন্তর্গত পৌষমেলার ময়দানকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের প্রাচীর দিয়ে ঘেরার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে’ ঘোর অশান্তি দেখা দিয়েছিল৷ জনসাধারণের বিশেষ করে যাঁরা প্রাচীর তুলতে বাধা দিয়েছেন, ভাঙাচুরও চালিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য ছিল এখানে বিশাল মেলা হয়, যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে৷ এটি এখন সর্বমানবের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে৷ একে কেন্দ্র করে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হয়৷ তাছাড়া, এই ময়দানে বহু ছেলে-মেয়ে খেলাধুলা করে, আনন্দ করে৷ এই খোলা মেলা মাঠকে কর্তৃপক্ষ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাইছে৷ এইভাবে কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের প্রবেশাধিকার হরণ করতে চাইছে৷ রবীন্দ্রনাথের মুক্ত পরিবেশের আদর্শও কর্তৃপক্ষ নষ্ট করতে চাইছে বিস্তীর্ন ময়দানকে প্রাচীরবদ্ধ করে৷ জনগণের কথায় কর্ণপাত করেননি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি আবার তিনজন ছাত্রছাত্রাকে বহিস্কার করা নিয়ে নতুন করে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে৷ এখানেও অভিযোগের আঙ্গুল উপাচার্যের দিকে৷

এইসব কারণে কর্তৃপক্ষের ও ছাত্রছাত্রাদের মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে৷ সেটা রবীন্দ্রনাথের কাম্য ছিল না৷

এ ব্যাপারে আমরা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসন ও  সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ করব, সবাই মিলে রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে রক্ষা করুন৷ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী দেশের গর্ব, আজকের  বিপথগামী সভ্যতাকে যথার্থ-পথ প্রদর্শনের এক বাতিস্তম্ভ৷

দেশের রবীন্দ্রনুরাগী বিদ্বৎসমাজকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে অনুরোধ  করব৷

তাছাড়া, কিছুদিন আগে এও খবর পাওয়া গিয়েছিল কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবাদে এখানে বাংলাভাষাকে অপাঙক্তেয় করার চেষ্টা হচ্ছিল৷ এখন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্র বাংলাতে লেখার ব্যবস্থা রয়েছে, এটা বন্ধ করার চেষ্টা চলছিল৷ শান্তিনিকেতনের অনেক সাইনবোর্ড থেকেও বাংলা হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এটা যদি হয় তাহলে তা হবে অমার্জনীয় অপরাধ৷

যে বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করে’ বাংলাকে বিশ্বসভার আসনে বসালেন, সেই বাংলার অপমান বাঙালীরা সহ্য করবে না৷ আগেই বলেছি, বিশ্ব বিদ্যালয়ের আর্থিক দায়িত্ব কেন্দ্র গ্রহণ করেছে বলে, এখানকার শিক্ষাদর্শের ওপর কোপ দেওয়ার কোনো অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের নেই৷

সবশেষে আবার বলব, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মহান্‌ আদর্শ যাতে ‘বিশ্বভারতীতে সুন্দরভাবে সুরক্ষিত থাকে, যাতে বিশ্বভারতীতে শান্তির পরিস্থিতি বজায় থাকে, তজ্জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যসরকারের প্রতিনিধি ও তৎসহ রবীন্দ্রানুরাগী বিদ্বৎসমাজের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে  বসে শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন৷  শান্তিনিকেতনকে  রাজনীতির কুস্তীর আখড়া বা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করবেন না৷