শারদোৎসব- দুর্গোৎসব-বিজয়োৎসব

লেখক
একর্ষি

‘‘ যা অস্তিত্বকে উদ্বেল ও উচ্ছ্বসিত করে দিয়ে বাঁচার আনন্দে জীবনকে পূর্ণ করে তোলে তাকেই বলে উৎসব’’---শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি৷

শারদোৎসব বা দুর্গোৎসব পূর্ণতা পায় বিজয়োৎসবে এই সমাসবদ্ধ পদটির অর্থ হল বিজয়সূচক যে উৎসব৷ পদে উৎসবেরই প্রাধান্য৷ এখন দেখা যাক এই উৎসব ব্যাপারটা কী৷ উৎসব শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায় উৎ-স+অল্৷ এই প্রত্যয় জাত প্রতিপাদিকটির মধ্যে ‘সু’ ধাতুর সঙ্গে ‘অল’ প্রত্যয়  লাগালে হয় ‘সব’৷ ‘সব’ এর অর্থ জন্মগ্রহণ করা৷ আর ‘উৎ’ মানে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা৷ অর্র্থৎ মানুষ যখন নেচে নেচে প্রাণের উছ্বাস দিয়ে নোতুন জীবনের আস্বাদন গ্রহন করে তখন তাকে উৎসব বলে৷

প্রশ্ণ হল- মানুষের  জীবনে উৎসব  এল কেন? অনুসন্ধিৎসু বলে-- একদিন অরণ্যচারী গুহাবাসী যাযাবর মানুষের জীবনে এলো কৃষিনির্ভর জীবনের নিশ্চয় নিরাপত্তা৷ আর কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ বিন্যাসে সর্বপ্রথম মানুষের হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত সময় জমতে লাগল৷ সঙ্গে তার মানসিক উৎকর্ষ ও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল৷ নানা জিজ্ঞাসার ভরে উঠল মন৷ সভ্যতার পথে আত্মজিজ্ঞাসায় সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাসের  পঁুজিও জমে উঠল৷ উদ্বৃত্ত অবসর সময় যেমন সে ব্যয় করতে শুরু করল নানামুখী চিন্তাভাবনায় ও অভিপ্রকাশে, তেমনি তার একটা  একটা বিশেষ অংশ  সে সঞ্চিত রাখল নানাপ্রকার  উৎসব ও আনন্দানুষ্ঠানের জন্যে৷ উৎসব হয়ে উঠল মানুষের প্রাণশক্তি বিকাশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার৷

সামাজিক মন বলে - সমাজের আনন্দই আমার আনন্দ, সামাজিক কল্যাণই আমার কল্যাণ৷ আবার  আত্মাভিমুখী মন বলে- আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হোক, আমার শুভ  সকলের শুভ হোক৷  আমি যা পাই তা আমি সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে উপভোগ করি৷ পিছিয়ে নেই কেজো মন৷  বলে-- চিরাভ্যস্ত গতানুগতিক একঘেয়েমি থেকে মুক্তি যে আমি চাই-ই চাই, চাই বৈচিত্র্যের আস্বাদন, চাই কর্মব্যস্ত জীবনে বিরাম ক্ষণকাল৷ গন্ডিবদ্ধ আমার জীবনকে বৃহত্তর  সায়রে অঞ্জলি দিয়ে অসংখ্য প্রাণের স্পর্শে পরিপৃক্ত করতে চাই৷ তাই তো জীবনপ্রবাহের  সঙ্গে উৎসব ধারা বহে চলে কাল থেকে কালান্তরে৷ উৎসব যে মানুষের সৃজনধর্মী প্রতিভারই  আনন্দমুখর অভিপ্রকাশ৷

উৎসবের অন্তরালে দার্শনিক ভাবনাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না৷ কেননা জীবনের সর্বক্ষেত্রে  মানুষকে  সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়৷ জীবনসংগ্রাম সার্বভৌমিক৷ সংগ্রামে বিজয়ের পরেই আসে অস্তিত্বকে  উদ্বেল ও উচ্ছ্বসিত করে বাঁচার আনন্দ তারপর বেঁচে থাকার মৌল প্রয়োজনগুলো করায়ত্ত ও অস্তিত্ব সুরক্ষিত হতেই উদ্বেল  ও উচ্ছ্বসিত মন ছোটে-- ইতি-উতি, ‘আমি কোথায় পাব তারে’,  ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’৷ তাই স্মরণাতীত কাল  থেকেই উৎসব শুরু হয়েছে কোন ঐশ্বর্যমন্ডিত  ঋতুকে কেন্দ্র করে  ও তা পরিণতি লাভ করেছে আধ্যাত্মিক ভাবনায়৷ অর্র্থৎ বর্হিজীবনের সঙ্গে সন্তুলন  করতে করতে অন্তর্র্লেকের দিকে এগিয়ে যাওয়া৷ এ যাওয়া স্থূল থেকে সূক্ষ্মের  দিকে৷ বলা বাহুল্য, এটাই বঙ্গীয়  তথা ভারতীয় জীবন ধর্ম৷  গ্রীষ্ম-বর্র্ষর  জীবন সংগ্রামে উর্ত্তীণ মানুষকে শরৎ বরণ করে  ঐশ্বর্যের ডালি নিয়ে৷ কৃতজ্ঞ  মানুষ প্রকৃতিকে বন্দনা করে শারদোৎসবে-দুর্র্গেৎসবে. ছট উৎসবে, পৌষ উৎসবে, বসন্তৎসবে--- ঋতুতে --ঋতুতে৷ তবে শারদোৎসব গৌরব মন্ডিত, বর্ণময় ও কীর্তিশ্রীভূষিত হয় দুর্র্গেৎসবের রোমাঞ্চ ও আবেগ-বিহ্বলতায়৷ শরতের আগমণে প্রকৃতি যেন নানান ফুলের ডালি সাজিয়ে মানুষের আরতি করে৷ বলে- এটাই তোমার ভালো সময়৷ উৎসবে প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্বেল  হয়ে ওঠো৷ শারদোৎসবের এই ভাবাত্মক দিকটি দুর্র্গেৎসবে সঞ্চালনের প্রয়াস থাকলেও তা মাত্রা পায়নি দেবী দুর্র্গর রূপকল্প-পৌত্তলিকতায়৷ এই উৎসব সর্বজনীন তকমায় চর্চিত উচ্ছ্বাসে গগনচুম্বী হলেও ব্যপ্তিতে আংশিকতায় আবদ্ধ৷

ইতিহাস বলে-- দুর্র্গেপূজার  ভাবনাটা  বেশীদিনের  নয়৷ পুরাণ আশ্রিত এই পূজার ভাবনা এসেছে বারোশো কি তেরোশো বছর পূর্বে  থেকে৷ আর বর্তমান দুর্র্গপূজার  শুরু কৃত্তিবাসী রামায়ণ সূত্রে পাঁচশত কি ছয়শত বছর পূর্বে৷ শারদোৎসব ব্যঞ্জনাটাই  হারিয়ে গেছে৷ দর্শণগত, বিজ্ঞান চেতনাগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, বা সাংসৃকতিক অনুপত্তিও কম নয়৷ কয়েকটা কথা না বললেই নয়৷ প্রথম কথা -‘‘ ঈশ্বরস্য প্রতিমা নাস্তি৷’’ কেন-না কোন জিনিসের  সঙ্গে  ঈশ্বরের তুলনা হয় না৷ আসলে মূর্তির দ্বারা খন্ডভাবের  অভিব্যক্তি ঘটানো হয়৷ ঈশ্বর যে অনন্ত ভাব, সেই অনন্ত ভাবকে  একটা মূর্তির  মধ্যে ফোটানো অলীক কল্পনা মাত্র, যা অসম্ভব৷ দ্বিতীয় কথা  যা মূর্তিতে অভিব্যক্ত তা খন্ড, কিন্তু ঈশ্বর যে অনন্ত অনন্তের কীরূপ দেখা যায়? এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সম্পূর্ণ বিজ্ঞান বিরোধী ভাবনা৷ তাহলে মূর্তিকে ঈশ্বর বললে ঈশ্বরকে মানা যায় না৷ আবার ঈশ্বরকে স্বীকার  করলে মূর্তিকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতীক বলা যায় না৷ তৃতীয় কথা,  ঈশ্বর সাধনা জড়মুখী নয় হরিমুখী৷ জড়পিন্ডকে ঈশ্বর মানলে, মূর্তিরূপী জড়ের সাধনা করলে ফল হবে জড়াত্মক৷ কেন-না ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধর্ভবতি তাদৃশী’ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন একেই বলেছেন প্রত্যেক কাজের অনুরূপ ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে৷ চতুর্থ কথা, ঈশ্বরের ভাব খন্ড, দৃষ্টি সংশ্লেষণাত্মক কিন্তু পৌত্তলিকতায় বা মূর্ত্তিতে খন্ডভাবের প্রকাশ, দৃষ্টি বিশ্লেষণাত্মক৷ একেই মূল্য দিতে গিয়ে দেবতার সংখ্যা ৩৩কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে৷  ফল দাঁড়াল--- মানুষে মানুষে বিভেদ৷  ধর্মের নামে ঈশ্বর বিশ্বাসের নামে মানুষের সমাজটাকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হল৷ তাহলে সার্বজনীন দুর্গোৎসব বলা যায় কী? পঞ্চম কথা - আসলে দুর্র্গপূজাটা বিত্ত বৈভবের আস্ফালনের  একটা মঞ্চ মাত্র৷ অর্থের সম্পদের দম্ভকে মাত্রা দিতেই বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার  তাহেপুর অঞ্চলের জমিদার কংসনারায়ণ রায় দুর্র্গপূজার প্রচলন করেছিলেন৷ এখন দম্ভ-আড়ম্বর-যাঁকজমক পাল্লা দিয়ে বাড়ছে৷ ভক্তির বা  আধ্যাত্মিকতার লেশ মাত্র নেই ৷  লোকদেখানো আড়ম্বর-অম্বর -ডম্বরই শেষকথা৷  উৎসবের আত্মাভিমুখী, সংশ্লেষণাত্মক ভাবনাটাই মাটি৷ কেবল ১৯৪৭ এর উত্তরকালে রাজা- জমিদারদের স্থান দখল করেছে  ক্লাব- বারোয়ারী৷ আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্র?  হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্গোৎসব কে কেন্দ্র করে বাংলার বাইরে বেরিয়ে যায়৷  বাংলার দেওলিয়া অর্থনীতি পঙ্গু আরও পঙ্গু হয়ে যায়৷  অন্যদিকে সাংসৃকতিক জগৎ ? বঙ্গ সংসৃকতি দূরহটো, অসংসৃকতির ‘আচ্ছে  দিন’৷

আচার সর্বস্ব দুর্র্গেৎসবের শেষ পর্ব হল বিজয়োৎসব বা শুভবিজয়া৷ এখানেও কয়েকটা কথা ভাববার আছে ৷  মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বি শক্তির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করে৷  একেই বলে জয়৷  আর এই জয় যখন স্থায়ী হয় তখন তাকে বলে বিজয়৷ বিজয়া দশমীর যে উৎসব বিজয়-দশমী তা ওই বিজয় কেন্দ্রিক৷  কিন্তু কিসের উপর বিজয়?  ‘মার্কে ন্ডয় পুরাণ’ অনুসারে অসুররাজ মহিষাসুর দেবতাদের  পরাজিত করে স্বর্গধাম দখল করে নিল দেবতারা স্বর্গচ্যুত অসুরদের অত্যাচারে দেবতাদের ত্রাহি ত্রাহি রব৷  এই পরিস্থিতিতে দেবতাদের মিলিত শুভপ্রয়াসে দেবীদুর্র্গর আবির্র্ভব৷ দেবতাদের দেব বলে বলীয়াণ  ও দেবতাদের দেওয়া নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সম্মূখ সমরে মহিষাসুরকে বধ করলেন৷  দেবতারা স্বর্গরাজ্য পূনরুদ্ধার করলেন৷  এটাই হল মহিষাসুর মর্দিনীর বা দুর্র্গেৎসবের ভাব৷  এই অসুর বিজয়কে স্মরণ করে বিজয়া বা বিজয়োৎসব৷ ‘পুরাণ ’ তো সাহিত্য ৷ এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তবে নীতিশিক্ষা আছে ৷ সিংহবাহিনী দেবী দুর্র্গর কল্পনায় যা আছে তা হল পশুশক্তির উপর দৈবশক্তির জয়৷  এটা একটা প্রতিকীরূপ মাত্র৷ শত্রু হল অসুর অর্র্থৎ পশুশক্তি, দুর্র্গ হলেন শুভশক্তি৷ অশুভ শক্তি বা শত্রু বা অসুরের সঙ্গে সংগ্রাম করে  শুভ বা দৈবশক্তির জয়৷ আসলে মানুষের জীবন দ্বি-স্তরীয় --- ব্যষ্টিজীবন ও সমাজ জীবন ৷ ব্যষ্টির মনের মধ্যে আছে অষ্টোপাশ বা ষড়রিপু রূপী অসুর৷ এরা ব্যষ্টির ভিতরের শত্রু৷ এই ভিতরের শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যই  ব্যষ্টি মানুষকে  আজীবন আধ্যাত্মিক সাধনা করে যেতে হবে৷ এ হল  মানস -আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ব্যাষ্টিজীবনের শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম৷ অন্যদিকে ‘সমাজজীবনে ’ সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে সে-ই  মানুষের  শত্রু যে তার প্রিয়াকে কাড়ে, কাড়ে ঘর বাড়ি, আগুন লাগায় শান্তির নীড়ে৷ যে মানুষকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রেখে , পীড়া দিয়ে, লাঞ্ছনা দিয়ে পশুস্তরে নামিয়ে আনতে চায় সে-ই  শত্রু, সে-ই অসুর৷ তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে৷ আবার যে নিয়ম বা দুর্নিয়মের ফলে সমাজ বিরোধীরা উৎসাহ পায় সেই সব নিয়ম, নীতি ও সমাজের শত্রু৷  তাই সেদিন ব্যষ্টিমানুষ ষড়রিপু-অষ্টপাশরূপী শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে ও সামাজিক মানুষ  সামাজিক শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে সেই দিনই প্রকৃত বিজয়োৎসব পালন করবে মানুষ৷ সেই বিজয়োৎসবই আসল বিজয়োৎসব৷  আর প্রতিবছরে যে বিজয়া বা বিজয়োৎসব তা প্রকৃত পক্ষে বিজয়োৎসবের মহরামাত্র৷  তাই উৎসবকে এই সামুহিক বিজয়োৎসবের মহরা বলা যায়৷ স্মরণীয়, সংগ্রামই  জীবনের ভিত্তি (এসেন্স)৷ ‘মানুষের সংগ্রাম  সার্বভৌমিক  অর্র্থৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংগ্রাম করে তাকে এগিয়ে যেতে হবে৷ সংগ্রাম করে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে পরমপুরুষ মানুষকে সব সময় প্রাণরস তথা প্রাণশক্তি যুগিয়ে চলেছেন ও সর্র্বত্মক সংগ্রামের প্রেরণা দিয়ে চলেছেন৷ মানবিক মূল্যবোধের দূরনিরীক্ষ্য দৃষ্টিতে সহজেই লক্ষ্য গোচর হয় যে মানবাত্মা অসহ্য ব্যগ্রতা নিয়ে বসে আছে কবে তাদের সামূহিক  জীবনের বিজয়োৎসব পালিত হবে৷                             ‘যতো ধর্ম ততো জয় ঃ’৷