শারদোৎসব ও শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর নববিধান

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বর্র্ষর বিদায় ৷ শীত এখনও আসেনি৷ আকাশে  শাদা মেঘের খেলা৷ নদীতীরে কাশের মেলা৷ বঙ্গ প্রকৃতির এমনি মনোরম পরিবেশ স্বাভাবিকভাবে উৎসবেরই পরিবেশ৷ তাই শারদোৎসব বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব৷ আর বাঙলায় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করেই শারদোৎসবের জোয়ার৷ পৌরাণিক কাহিনী আধারিত দুর্গাপূজা ধর্মীয় অনুষ্ঠান৷ তবে বর্তমানে ধর্মের মূল সুরের সঙ্গে এর সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি৷ দুর্গাপূজায় বর্তমানে মঞ্চ ও মূর্ত্তি গড়ার ব্যাপারে চরম প্রতিযোগিতা চলে৷ কেউ চকোলেট দিয়ে, কেউ বিসুকট দিয়ে, কেউ ভাঁড় দিয়ে, কেউ আখের ছিবড়া দিয়ে, এমনি নানান্ উদ্ভট উদ্ভট উপাদান দিয়ে মঞ্চ ও মূর্ত্তি গড়ার  প্রতিযোগিতা চলে৷ কে কত বড় ঠাকুর গড়েছে, কে কোন্ মন্দিরের আদলে মঞ্চ তৈরী করেছে, সেই নিয়েও জরবদস্ত প্রতিযোগিতা হয়৷  বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বা চলচ্চিত্রের  নায়ক-নায়িকাদের  এনে পূজা উদ্বোধন করারও  প্রতিযোগিতা চলে৷ বলা বাহুল্য, ব্যয়বহুল মঞ্চ ও মূর্ত্তি গড়ার  প্রতিযোগিতাটাই এই পূজার মূল আকর্ষণ৷ তারপর তো রয়েছে দর্শককুলের সাজগোজের প্রতিযোগিতা৷ তার সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণও রয়েছে৷ দুর্গাপূজায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পুলিশকে হিমসিম খেতে হয়৷

মনে সবিস্ময় প্রশ্ণ জাগে, দুর্গাপূজার এই বিশাল সমারোহের মধ্যে প্রকৃত ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া কতটুকুই না রয়েছে৷ কেবল উন্মত্ততা৷ বিসর্জনের উচ্ছৃঙ্খলতা সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ার মত৷ চরম উচ্ছৃঙ্খলতার ওপর তথাকথিত ধর্মের তক্মা দেওয়া হচ্ছে৷ তথাকথিত শিক্ষিত, পণ্ডিত ও যুক্তিবাদী মানুষেরাও ডগ্মার বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ রেখে বড় বড় বুলি  আওড়াচ্ছেন৷ চরম অন্ধ কুসংস্কারকে সামাজিক প্রথা বলে অযৌক্তিক যুক্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করছেন৷

আর এই তথাকথিত উন্মত্ত আনন্দের জোয়ার কিন্তু মূলতঃ শহরকে কেন্দ্র করে৷ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বেশীর ভাগ মানুষই এই ‘আনন্দে’র ছোঁয়া পায় না৷ তারা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকছে৷ নোতুন জামা-কাপড়ও তাদের ভাগ্যে জোটেনি৷ তাদের কথা ভাববার অবকাশ শহরের বাবুদের নেই৷

উৎসব সমাজের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন৷ উৎসবের মাধ্যমে প্রাত্যহিক একঘেয়েমীর জীবন থেকে সরে এসে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে৷ একঘেয়েমী কেটে যায়৷ জীবন প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে৷ কিন্তু এই উৎসব এমন হওয়া উচিত যা মানুষকে ডগ্মাতে আবদ্ধ না করে৷ উৎসবের নামে মানুষ যেন নিজের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ বুদ্ধিবৃত্তিকে ভোঁতা করে দিয়ে বিপথে না যায়, অযৌক্তিক অমানবিক প্রথা-পদ্ধতিকে প্রশ্রয় না দেয়, প্রগতির পরিবর্তে অধোগতির পথে না হাঁটে৷ আজকের মানব-সংহতি ও সংশ্লেষণের যুগে মানুষ যেন সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার পথে না হেঁটে সমগ্র মানব সমাজকে এক করার পথে চলতে পারে৷

এই সমস্ত দিক বিবেচনা করে আদর্শ মানব সমাজ রচনার দিশারী শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ‘শারোদৎসবে’র নোতুন বিধান দিয়েছেন, যা মানব প্রগতির ক্ষেত্রে এক অভিনব পদক্ষেপ৷

শরতের মনোরম পরিবেশ মানুষের মনে  আনন্দের দোলা দেয়৷ তাই এই পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তিনি ‘শারদোৎসবে’র নোতুন বিধান দিয়েছেন৷ তাঁর বিধান অনুসারে শারোদৎসবের পাঁচ দিনের উৎসবের প্রথম দিন হবে (১) ষষ্ঠীতে--- শিশুদিবস৷ তাতে থাকবে এক বেলা মিলিত ঈশ্বর সাধনা সহ আনন্দ অনুষ্ঠান, শিশু প্রদর্শনী, শিশুদের ক্রীড়া প্রদর্শনী ও শিশুদের মিলিত ভোজ৷ (২) সপ্তমীতে---সাধারণ দিবস৷  এক বেলা মিলিত ঈশ্বর সাধনার সঙ্গে আনন্দ অনুষ্ঠান, যুব স্বাস্থ্য প্রদর্শনী, প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্রীড়া প্রদর্শনী ও শক্তি প্রদর্শনী৷ (৩) অষ্টমীতে---ললিত কলা দিবস৷ এই দিন বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে থাকবে সাহিত্য সভা ও নানা প্রকার ললিত কলা প্রদর্শনী৷ (৪) নবমীতে ---সঙ্গীত দিবস৷ এই দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকবে সঙ্গীত, যন্ত্র সঙ্গীত ও নৃত্য প্রতিযোগিতা৷ (৫) বিজয়া দশমীতে---বিজয় উৎসব৷ বর্ণাঢ্য বস্ত্র পরিধান করে বাদ্যযন্ত্র সহ, তাণ্ডব নৃত্য সহ শোভাযাত্রা৷ অতঃপর মিলিত সাধনা, প্রণাম ও আলিঙ্গনাদি, নিজ নিজ গৃহে অতিথি ও অভ্যাগতদের আপ্যায়ন৷

এই শারোদৎসব বিশ্বের সমস্ত দেশে সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষের জন্যেই সর্বজনীন, সমস্ত মানুষের মহা মিলনের উৎসব৷