স্বাধীনতার ৭৪ বছরে অর্থনৈতিক শোষণ গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিতান্ত্রিক৷ প্রশাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক৷ মিশ্র অর্থনীতির এ এক ‘সোনার পাথরবাটি’৷ ভারতবর্ষকে বিশ্বের বৃহত্তম গতণন্ত্র বলে বড়াই করা হয়৷ কিন্তু স্বাধীনতার ৭৪ বছর  পর দেশের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় গণতন্ত্র এখানে এক বিরাট ভাঁওতা৷ গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে, জনগণের সরকার৷ কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভারতের গণতন্ত্রকে বলা যায়---বৈশ্যদের দ্বারা, বৈশ্যদের জন্যে, বৈশ্যের সরকার৷ জনগণ এখানে ভোট দেবার যন্ত্র মাত্র৷ রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, প্রচারমাধ্যম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, পুলিশ-প্রশাসন এমনকি খেলার মাঠও বৈশ্য শোষকের কালো হাতের নিয়ন্ত্রণে চলে৷

দেশীয় পুঁপতিদের স্বরূপ প্রথম চিনেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সামনে এক সভায় সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন---‘দেশীয় পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শক্তি অর্জন করছে৷ অর্থাৎ বিদেশী শাসক ও দেশীয় বৈশ্য শোষকের মধুর সম্পর্ক পরাধীন ভারতে গড়ে উঠেছে৷ স্বাধীন ভারতে দেশীয় শাসক আসায় শাসক ও বৈশ্য শোষকের সেই সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছে৷ সুভাষচন্দ্র সেদিনই বুঝেছিলেন যে দেশে জনগণের বৃহত্তম অংশ সামাজিক - অর্থনৈতিক -রাজনৈতিক চেতনাহীন,সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নেতা-আমলা, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবই বৈশ্য শোষকের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে৷ জনগণ সামাজিক-রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক ভাবে সচেতন না হলে গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হবে৷ বাস্তবিক তাইই হয়েছে৷ দেশীয় পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় সুভাষচন্দ্রকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে উৎখাত করা হয়েছে৷ স্বাধীনতার অনেক আগেই দেশপ্রেমের মুখোশের আড়ালে রাজনৈতিক নেতারা বৈশ্য শোষকের হাতের পুতুল হয়ে যায়৷ স্বাধীনতার পর শুধু রাজনৈতিক দল ও নেতা নয়, দেশের শাসন ক্ষমতা পরোক্ষভাবে বৈশ্য শোষকরাই নিয়ন্ত্রণ করে৷ তাই দেশের অধিকাংশ নাগরিক আজও অশিক্ষার অন্ধকারে, অনাহারে, অর্দ্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে৷

এই জনগণই ভোট দিয়ে শাসক নির্বাচন করে৷ গণতন্ত্রে এমনটাই নিয়ম৷ কিন্তু দেশের জনগণের এক বিরাট অংশ বোঝেই না কাকে ভোট দেয়, কেন ভোট দেয়? অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের নামে নেতাদের পোষ্য চেলা-চামুণ্ডারাই ভোট দিয়ে থাকে৷ রাজনৈতিক দলগুলি পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করে থাকে৷ নির্বাচনে যে ব্যাপক কালো টাকার লেনদেন হয় তা দেশের অতি মুর্খ লোকটিও বিশ্বাস করে৷ অর্থের বিনিময়ে, দীনতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এখানে ভোট ক্রয়-বিক্রয় হয়৷ শুধু ভোটার নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায়৷ অনেক সময় দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচতেও বিরোধী দল ছেড়ে শাসক দলে যোগ দেয়৷ সম্প্রতি দেখাও গেছে বিরোধী দলে থাকার সময় যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে সরব শাসক দলের নেতারা, শাসক দলে যোগ দিয়েই সেই নেতারা ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে গেছে৷ গত লোকসভার সাধারণ নির্বাচনেও প্রচুর কালো টাকার লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে৷ নির্বাচন কমিশনও অনেক কালো টাকা উদ্ধারের কথা স্বীকার করেছেন৷ তাই ভারতবর্ষের গণতন্ত্র কখনোই জনগণের দ্বারাও নয়, জনগণের জন্যেও নয়৷ কোনও নির্বাচনেই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হয় না৷

রাজনৈতিক দলের নেতারা তো বটেই, গণতন্ত্রে মূল স্তম্ভগুলো যেমন বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, সংবাদ মাধ্যম, আমলা সবই আজ বৈশ্যের অর্থের দাস৷ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টেও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেরই  অন্য বিচারপতিরা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে সরব হয়েছেন৷ আবার সুপ্রিম কোর্ট তো বটেই সিবিআই-এর ভেতর থেকেও সিবিআই-এর বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিযোগ উঠেছে৷ গত লোকসভা নির্বাচনে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে তাঁরই এক সদস্য একই ধরণের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন৷ তাই বৈশ্য শাসনতন্ত্রে জনগণ ভোট দানের এক নির্বোধ যন্ত্র মাত্র৷ বৈশ্যের অর্থে পুষ্ট, ধূর্ত রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে যেমন চালায়, তারা তেমন চলে৷ গণতন্ত্রও বৈশ্য শোষণের একটা হাতিয়ার মাত্র৷ এই হাতিয়ারকে অবলম্বন করেই জনগণকে দল, উপদল, সম্প্রদায়ে ভাগ করে বৈশ্য শোষকরাই ঠিক করে ক্ষমতার গদীতে কাকে বসাবে৷ বোকা জনগণ দলে দলে দলাদলি করেই, সম্প্রদায় সম্প্রদায়ে হানাহানি করে মরে৷

স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে আছে৷ অনাহারে, অর্দ্ধাহারে দিনযাপন করেন৷ অথচ মন্দির মসজিদ্‌ গড়তে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়৷ এর ১০ শতাংশও যদি জনশিক্ষার খাতে ব্যয় হ’ত তবে ভারতবর্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক চেহারা বিশ্বের যে কোন দেশের থেকে অনেক উন্নত হ’ত৷ জনশিক্ষা নয়---স্বাধীনতার ৭৪ বছরে জনগণের জন্যে চটুল রসে যৌনতা মার্কা চলচিত্র, সঙ্গীত প্রভৃতি নিম্নমানের অশ্লীল, অসংস্কৃতির ঢালাও ব্যবস্থা হয়েছে৷ এই ধরণের অসংস্কৃতির প্রভাব শুধু জনমনে  নয়, রাজনৈতিক নেতাদেরও প্রভাবিত করে৷ সম্প্রতি কশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কিছু রাজনৈতিক নেতার কশ্মীরী মহিলাদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য এই ধরণের যৌনতামার্কা অসংস্কৃতিরই প্রভাব৷

সব রাজনৈতিক নেতারাই যে এমন তা নয়, কিন্তু জনগণকে বিপথগামী করে রাখতে ওই ধরণের কয়েকজন নেতাই যথেষ্ট৷ কারণ এইসব নেতারাই বৈশ্যতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শোষকদের খুব কাছের মানুষ হয়৷ এই বৈশ্য শোষকরাই অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতা ও তাদের চ্যালা-চামুণ্ডাদের সাহায্যে জনগণকে, জনমতকে নিজেদের ইচ্ছামত নিয়ন্ত্রণ করে৷ জনগণের স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতাও কম, যাদের আছে তারাও বৈশ্যের অর্থের দাস হয়ে যায়৷ তাই ভারতে বৈশ্যতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বৃহত্তম গণতন্ত্র এক প্রহসন মাত্র৷