মানুষ সামাজিক জীব, তাই সমাজের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নিয়ে একসাথে চলায় প্রয়াসী৷ জীবনের চলার পথে এই স্বাভাবিক ছন্দটা যখন বিঘ্নিত হয় অথবা কোন ঘটনা আমাদের সমাজ-ভাবনার শিকড়টা ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়---তখনই আমাদের মনে ও সমাজ জীবনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে৷ এইরকমই একটি ঘটনার ভিডিও কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে ও জনসমক্ষে এসেছে৷ ভিডিওতে দেখা যায়, ফুল দিয়ে সাজানো একটি মৃত দেহ দড়ি বেঁধে নদীর ওপরের সেতু থেকে নীচে নামিয়ে দিচ্ছেন কয়েকজন মানুষ ও পরে নদীর ধারে সেই মৃত দেহের সৎকার করা হয়৷ ঘটনাটি ঘটে গত ১৭ই আগষ্ট শনিবার৷ সেইদিন তামিলনাড়ুর ভেলোর জেলার বানিয়ামবাড়ি অঞ্চলে স্থানীয় নারায়ণপূরম দলিত কলোণীর বাসিন্দা কূপ্পান পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন৷ পালার নদীর ধারে শ্মশানে যাবার রাস্তার দুই পাশের জমির মালিক তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন৷ তাদের আপত্তিতে ওই রাস্তা দিয়ে দলিত সম্প্রদায়ের মৃতদেহ বহন করা নিষিদ্ধ হয়েছে৷ তাই দলিত সম্প্রদায়ের মৃতদেহগুলি সৎকারের জন্যে এইভাবেই দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে সেতু থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়৷ গত কয়েকবছর ধরেই এই ব্যবস্থা চলছে৷ এতদিন ধরে এই ব্যাপার চলে আসছে জেনেও স্থানীয় প্রশাসন কোন বিকল্প জমি বা পথের ব্যবস্থা করে নি৷ এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের বোধোদয় হয়৷ প্রশাসনের তরফে তড়িঘড়ি দলিতদের মৃতদেহ সৎকারের জন্যে আলাদা জমির ব্যবস্থা করার তোরজোর চলে৷ একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন নিজেকে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তন মননে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপায় ভূষিত করতে ব্যস্ত, সেই সময় এই ধরণের অমানবিক ঘটনা সত্যই অত্যন্ত লজ্জার ও বেদনার৷ এর পূর্বেও এক দলিতের মৃতা স্ত্রীকে কাঁধে নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে হাসপাতাল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের বাড়ির দিকে আসার ছবিও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, কারণ তার স্ত্রীর মৃতদেহ বহন করার জন্যে হাসপাতাল বা প্রশাসন থেকে কোন যানবাহনের ব্যবস্থা হয়নি৷ পরে রাস্তায় ওই অবস্থায় মৃতদেহ বহন করতে দেখে পাশের গ্রামের লোকজন তার সাহাযার্থে এগিয়ে আসেন ও গাড়ির ব্যবস্থা করেন৷ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ‘‘উন্নাও কাণ্ড’’ ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রম মানুষের সমাজে আরও একটি জঘন্য, বীভৎস ও চরম লজ্জার নিদর্শন৷ অবশ্য সংবাদ মাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে যে দু-চারটে ঘটনা প্রকাশিত হয় তা সংখ্যায় অতি অল্প--- এমন অজস্র অত্যাচার, অনাচার, যৌন উৎপীড়ন ও অমানবিক ঘটনাগুলি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায় আর ‘‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’’৷
সামাজিক বিবর্তনের ধারা বেয়ে মানুষ ধাপে ধাপে এগিয়ে এসেছে৷ তবে একশ্রেণীর চতুর সম্পদশালী ও বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে উন্নত মানুষেরা অন্যদের ওপর তাদের প্রভুত্ব ও শোষণ চালিয়ে যাবার জন্যে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করেছে৷ জাত-পাত, বর্ণ-ধর্ম, ছোটজাত-নীচু জাত, দলিত, হরিজন, উঁচুজাত ইত্যাদি বিভিন্নভাবে সমাজটাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছে৷ তারপর নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার মতলবে স্বরচিত তথাকথিত শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে হাজার গণ্ডা বিধি-নিষেধের জালে সাধারণ মানুষকে আবদ্ধ রেখে শোষণ চালিয়ে গেছে৷ তথাকথিত ছোটজাত-নীচু জাত বা দলিতদের ছায়া মাড়ালে পাপ হবে--- স্নান করতে হবে, স্পর্শ করলে জাত যাবে, এক পঙ্ক্তিতে বসা চলবে না, এক কুঁয়ো থেকে জল নেওয়া যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি কত-শত, বাধা-বারণের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়েছে৷ এইসব প্রতিবন্ধকতায় সবচেয়ে বেশি শোষিত, লাঞ্ছিত উৎপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী সমাজ৷ তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষজনেরা দিনের আলোয় ধোয়া তুলসীপাতার মতো আচরণ করলেও রাতের আঁধারে সেই নীচু জাতের মানুষদের দিয়েই নিজেদের বিকৃত লালসা চরিতার্থ করতে কার্পণ্য করেনি--- আর সকাল হলেই স্মান সেরে গলা-নাক-কপালে তিলক কেটে শুদ্ধ পবিত্র হয়ে সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্র্ত সেজে বসেছে৷ মানুষ সভ্যতার বড়াই করলেও সেই শোষণের ধারা আজও প্রবহমান--- দিনের আলো আর রাতের আঁধারে বিস্তর ফারাক৷ বিশাল দেশ এই ভারতবর্ষের গ্রামে-গঞ্জে, এমনকি শহরাঞ্চলেও এই দৃশ্য বহাল তবিয়তে বিদ্যমান৷
এতসব অনাচার , ব্যভিচার, অত্যাচারের মূল কারণ হচ্ছে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার বাড়বাড়ন্ত৷ গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ এখনও কুসংস্কার, ভাবজড়তা, তুক-তাক ও জাত-পাতের মায়াজালে জড়িয়ে রয়েছেন৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্তির অভাব৷ সকলের জন্যে এখনও অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষার সংস্থান করা যায়নি৷ ফলে দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা করার তাগিদে এইসব মানুষেরা তথাকথিত ধনী ও উচ্চবর্ণের শোষকদের তাঁবেদারি ও তোষামোদ করতে বাধ্য হন৷ সেই দুর্বলতার সুযোগে তাদের ওপর শোষণের ষ্টীমরোলার চলতে থাকে৷ উচ্চবিত্ত শোষকদেরসঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় রাজনীতিকদের দল৷ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তথাকথিত নিম্নবর্ণের দলিতদের ব্যবহার করে৷ তাদের জন্য সংরক্ষণ ও আন্দোলনের নামে দলিত ও নিম্নবর্ণের লোকেদের হাতিয়ার করে নিজেদের মৌরসী পাট্টা কায়েম রাখে, কিন্তু বাস্তেেব মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন সংঘটিত হয় না৷ এছাড়া ওই নিম্নবর্গীয় দলিতদের মধ্যেও বিভিন্ন ভাগ ও গোষ্ঠীগত বিভাজনকে উস্কে দিয়ে নেতা-নেত্রীরা দলীয় রাজনীতির খেলা চালিয়ে যায়৷ সংবাদপত্র, টেলিভিশন,ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত হিংসাত্মক, উদ্দীপক, চটুল, অশ্লীলতাপূর্ণ দৃশ্যাবলী ও সংবাদ পরিবেশিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে জনমনে, বিশেষতঃ অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে ও শিশুদের মনে বিরূপ ছাপ পড়ে৷ যার ফলে মানুষের মনে প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, স্নেহ-মায়া- মমতা ইত্যাদি সুকোমল শুভবৃত্তির পরিবর্তে অসংসৃকতিমূলক অশুভবৃত্তির উদ্রেক হয় ও বৈবহারিক জগতে অশুভ চিন্তা-ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে--- সমাজে হিংসা,অনাচার, পাপাচার বৃদ্ধি পায়৷ এইভাবে মানবিক মূল্যবোধের নিরিখে সমাজও ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়---
‘‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে৷
অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান৷’’
বর্তমান ভারতবর্ষ তথা সমগ্র পৃথিবীকে এই পশ্চাদপসরণের করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে৷ স্মরণে রাখতে হবে---‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই৷’’ সমস্তরকম জাত-পাত, ধর্মমত, বর্ণ, সম্প্রদায়গত ভেদাভেদের শৃঙ্খলমুক্ত হতেই হবে৷ তাই বর্তমানে বৈশ্য শোষণের ধারক ও বাহক হিসেবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে নব্যমানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে---যে শিক্ষার প্রথম পাঠই হচ্ছে, মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ আনন্দমার্গের নব্যমানবতাবাদী শিক্ষার মূলনীতি হল ‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’’ আর এই শিক্ষাপদ্ধতির দ্বারা বিশ্বের ১৮২টি দেশে ছাত্র-ছাত্রাদের শৈশব থেকেই প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্রতে আত্মনিয়োগ করেছেন আনন্দমার্গের লক্ষ লক্ষ সেবাব্রতী শিক্ষক শিক্ষিকাগণ৷ নব্যমানবতাবাদী শিক্ষায় প্রতিটি মানুষসহ সমগ্র বিশ্বের সকল সৃষ্টিকেই পরমপুরুষ বিশ্বপিতার সন্তান-সন্ততি রূপে গণ্য করা হয় ও সকলের কল্যাণের জন্যে সেবার ভাবনাকে উজ্জীবিত ও উৎসাহিত করা হয়৷ সমগ্র সৃষ্টির সঙ্গে সকলকে প্রেম-প্রীতি ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপনের শিক্ষা প্রদান করা হয়৷ অর্র্থৎ শিক্ষায়তনগুলি হল প্রকৃত মানুষ গড়ার কারখানা যেখানে মানুষের ত্রিবিধ বন্ধন, যথা---জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন মুক্তির পথনির্দেশনা ও নিয়মিত অনুশীলনের দ্বারা এই শিক্ষাপদ্ধতিকে বাস্তবায়িত করা হয়৷ ফলে মানুষের মধ্যে শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিক চেতনা, মানবিক চেতনা ও সামাজিক চেতনার উন্মেষ হতে থাকে৷ আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক এই নব্যমানবতাবাদী শিক্ষার প্রসারে সমাজের সর্ববিধ কালিমা, শোষণ,উৎপীড়ন, ক্রমে ক্রমে দূর হয়ে একটি প্রকৃত শোষণমুক্ত মানবসমাজ গড়ে উঠবে যেখানে কোনো ভেদাভেদ বা শোষণ-বঞ্চনার মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না৷ এই সমাজে প্রত্যেকে প্রত্যেকের উন্নতিকল্পে সদা সচেষ্ট থাকবে---মানুষের মানবিক মূল্যেবোধের প্রতি যথোচিত শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শিত হবে৷ এই নব্যমানবতাবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের জন্যে প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ যতশীঘ্র এগিয়ে আসেন মানবসমাজের পক্ষে ততই মঙ্গল৷ এই মর্মে স্মরণ করি মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর অমর বাণী ---‘‘সবাই মিলে’ একসঙ্গে চলার নামই সমাজ৷ যে পেছিয়ে রয়েছে, তাকে ঘৃণা না করে’ এগিয়ে আসতে সাহায্য কোরো৷ এটাই হবে তোমার সমাজ-ধর্ম৷’’
- Log in to post comments