‘খভ্রান্তি’ শব্দের একটি অর্থ হল চিল (কালো চিল ও শঙ্খচিল দুই–ই)৷ ‘ভ্রম্’ ধাতুর অর্থ ভুল করা নিলে ‘খভ্রান্তি’ শব্দের একটি যোগারূধার্থ হবে–যে একই ভুল বার বার করে চলেছে৷ একই ভুল জেনে বা না জেনে অনেকেই করে থাকে৷ ধরো, কোন একজন অনেকগুলি সংখ্যাকে উপর থেকে নীচে গুণে চলেছে৷ বার বার গণনায় ভুল হচ্ছে৷ খোঁজ নিলে দেখা যাবে একটি জায়গায় বার বার মনে মনে সে বলে চলেছে ৫৬ঞ্চ১২৷ এই ধরণের ভুলকেও ‘খভ্রান্তি’ বলা হয়৷ ‘খভ্রান্তি’র হাত থেকে বাঁচবার অন্যতম উপায় হল উল্টো পথে চলা যেমন গণনার ক্ষেত্রে উপর থেকে নীচে গুণতে গিয়ে ‘খভ্রান্তি’তে পড়ছ, তো সেই স্থলে এই ‘খভ্রান্তি’–র হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে নীচের থেকে ওপরে গোণ৷ এবার ৫৬ঞ্চ১২ না বলে আশা করা যায় বলবে ৬৫ঞ্চ১১৷
আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল–বয়সে ছিল আমার চেয়ে কিছুটা ছোট৷ তার ‘খভ্রান্তি’ ছিল–স্বেচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, মিথ্যে কথা বলা৷ তাকে বকাঝকা করলে সে বলত, ‘‘কী করব দাদা, মুখ থেকে বেরিয়ে যায়৷ যদি ঠিক বলতেও চাই তবুও স্বভাবগতভাবে মিথ্যে বেরিয়ে যায়৷ সেই যে ছড়ায় আছে না–
‘‘মনে করি হেন কর্ম করিব না আর,
স্বভাবে করায় কর্ম কী দোষ আমার৷’’
যারা তার স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছল সেই সব আত্মীয়–নাত্মীয় চেনা–চেনা সবাই তার সম্পর্কে বলত–ও যখন যা কিছুই বলুক না কেন তা’ গ্রহণ করার আগে তা’ ভাল করে চেলে নিবি৷
একবার আমি তাদের জিজ্ঞেস করলুম–হ্যাঁরে, তোরা যে চেলে নিতে বলছিস তা কী রকম চালুনিতে চালতে হবে?
ওরা বললে–নারায়ণগঞ্জ বাজারের একটা দোকানে খুব মিহি চালুনি পাওয়া যায়৷ সেই চালুনিতে চালতে হবে৷
আমার সেই আত্মীয়টি সব শুণে বললে–আমার মিে থ্য এতই সূক্ষ্ম যে তা’ চালবার মত চালুনি এখনও পৃথিবীতে তৈরী হয়নি৷
আমি ধমকে দিয়ে বললুম–হ্যাঁরে, তুই যখন আমার সঙ্গে কথা বলবি তখন আমাকেও চালুনি নিয়ে বসতে হবে নাকি?
সে আমাকে একটু ভয় পেত৷ সে বলল–না দাদা, আপনার চালুনির দরকার পড়বে না৷ যদি একান্তই দরকার পড়ে মোটা চালুনিতেই চলবে৷
আমি বললুম–ওসব ন্যাকামি ছাড়৷ আজ থেকে সত্যি কথা বলা অভ্যেস কর৷
পরের দিন ওর বন্ধুরা আমার কাছে এসে নালিশ করে বললে–ও আবার মিথ্যে বলছে৷
আমি বললুম–কী মিথ্যে বলেছে?
ওরা বললে–ও বলছিল, রংপুর জেলাটা নাকি আগে বুড়ীগঙ্গার চর ছিল৷
আমি বললুম–হ্যাঁরে, এখনও অভ্যেসটা ছাড়লি না কেন?
সে আমাকে কাকুতি–মিনতি করে বললে–দাদা, আপনারে কথা দিতেসি, এ্যামনডা আর অইব না৷
আমি বললুম–ঠিক আছে, কথা দিলি–তা’ মনে রাখিস যেন৷
পরের দিনই ওর বন্ধুরা এসে বললে–ও আবার মিথ্যে বলেছে৷
আমি বললুম–কী বলেছে?
ওর বন্ধুরা বললে–ও বলেছে, বঙ্গোপসাগরটা নাকি আগে ওর পিসেমশাইয়ের জমিদারীতে ছিল৷
আমি আবার ওকে মুখঝামটা দিয়ে বকাঝকা করলুম৷ বললুম–আবার যদি মিথ্যে বলিস তোরে মাইর্যা ফ্যালাই দিমু’’৷
সে বললে–না দাদা৷ আর কখনও এমনডা অইব না৷ আমি আপনারে পাকা কথা দিতেসি৷
তার পরের দিন ওর বন্ধুরা আবার আমার কাছে এসে মামলা দায়ের করে বললে–দাদা, ও আবার মিথ্যে কথা বলেছে৷
আমি বললুম–কী বলেছে?
ওর বন্ধুরা বললে–ও বলেছে, ওর ঠাকুরদার যেটা সব চেয়ে বড় হাতী অর্থাৎ ঐরাবত ছিল তার নাকটা ছিল শূর্পনখার নাকের মত৷
আমি ওকে অনেক বকাঝকা করলুম৷ বললুম–তোর কথার দাম রাখতে পারিস না কেন রে?
ও বললে–দাদা, মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়৷ এবার আমি আপনারে পাকা ফাইন্যাল কথা দিতেসি৷ আর এ্যামনডা অইব না৷
তার পরের দিন বন্ধুরা আমার কাছে এসে রিট পিটিশন করে জানালে–ওর মিথ্যে বলা স্বভাব৷ মানুষ কেন, দেবতারাও সারাতে পারবে না৷ আমি বললুম–ও আবার কী মিথ্যে বলেছে?
ওরা বললে–ও বলেছে, ও নাকি আসলে ভূত৷ ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্যে পোষাক পরে সেজে–গুজে থাকে৷
আমি শুধোলুম–হ্যাঁরে, এসব কী কথা শুণছি
ও বললে–দাদা, এবার আমি আপনারে এক্কেরে পাকা ফাইন্যাল কথা দিতেসি, ভবিষ্যতে আর এ্যামনডা অইব না৷
তারপর কী হয়েছিল আর আমি খোঁজ নিইনি....তার পরেই বাঙলা ভাগ হয়ে গেছল কিনা৷
তা হলে তোমরা ‘খভ্রান্তি’ কাকে বলে বুঝলে তো (শব্দ–চয়নিয়কা ১৩শ খণ্ড)