স্বদেশ প্রেমের অপর নাম ঃ তেইশে জানুয়ারী

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

যে সুযোগ আসছে সেটা সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে৷ সেজন্য নিজেরা জাতি ও ধর্মনির্বিশেষে  অবিলম্বে সংঘবদ্ধ হন৷  চাই ঐক্য ও একাগ্রতা৷’’

সুভাষচন্দ্রের এই বেতার ভাষণ শুণে সমগ্র দেশবাসীর মনে  স্বাধীনতা প্রাপ্তির একটা আশা ও আবেগের সঞ্চার হল৷

বাংলার আর এক কৃতী সন্তান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছিলেন ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’৷ রাসবিহারী বসুর অনুরোধে সুভাষচন্দ্র গ্রহণ করলেন ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’র সর্র্বধিনায়কের দায়িত্ব৷ সুভাষচন্দ্রের অমায়িক ব্যবহার, শৃঙ্খলাপরায়ণতা ও তেজোদ্দীপ্ত ব্যষ্টিত্ব সকলকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল৷ বাহিনীর সকলে সুভাষচন্দ্রকে ভালবেসে ‘নেতাজী’ নামে সম্বোধন করতেন৷ সেই আজাদ হিন্দ  বাহিনীর ‘নেতাজী’ ক্রমশঃ আপামর ভারতবাসীর ‘নেতাজী’তে পরিণত হলেন৷ নেতাজীকে পেয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে দেখা দিল এক অভূতপূর্ব প্রাণের জোয়ার৷ নেতাজী দৃপ্ত কন্ঠে আহ্বান জানালেন---‘‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো’’৷ নেতাজীর এই উদাত্ত আহ্বান বাহিনীর সৈন্য সামন্ত ও সাধারণ ভারতীয়দের মনে এক বিদ্যুৎ শিহরণ সঞ্চারিত করল--- যার অভিঘাতে দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মবিসর্জনের জন্যে সমস্ত ভারতবাসীর মধ্যে স্বদেশ প্রেমের প্রেরণা দেখা দিল৷ ১৯৪৩ সালের ৫ই জুলাই সিঙ্গাপুরের টাউন হলের বিপরীত দিকের বিরাট মাঠে তাঁর সেনাবাহিনীকে সম্বোধন করে তিনি বলেছিলেন---‘‘সশস্ত্র সংগ্রাম করে ও রক্তের বিনিময়ে তোমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে৷ তারপর ভারত স্বাধীন হলে স্বাধীন ভারবর্ষের একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে, যার কাজ হবে চিরকালের জন্য সেই স্বাধীনতা রক্ষা করা৷  আমাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন অটল ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে হবে, যাতে ইতিহাসে আর কখনও যেন আমরা স্বাধীনতা না হারাই৷’’....

তিনি আরও বলেছিলেন ---‘‘আমি তোমাদের আশ্বাস দিতে পারি যে অন্ধকারে ও আলোকে,               দুঃখে ও আনন্দে, দুর্র্যেগ ও বিজয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো৷....

আমি তোমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা,কষ্ট, বিরামহীন সংগ্রাম ও মৃত্যু ছাড়া কিছুই দিতে পারি না৷ কিন্তু তোমরা যদি আমাকে জীবনে ও মরণে অনুসরণ করো, আমি তোমাদের নিয়ে যাব বিজয়ের ও স্বাধীনতার পথে৷’’

তিনি আহ্বান জানালেন--- হে আমার সৈনিক বৃন্দ! তোমাদের রণধবনি হোক -দিল্লি চলো ! চলো দিল্লি৷’’

স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের যুক্ত করার জন্যে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে গড়ে তুললেন ‘‘ঝাঁসীর রাণী  বাহিনী’’৷ তাঁর এই পদক্ষেপের ফলে নারীগণও দেশ জননীর মুক্তিযুদ্ধে  আরও বেশি করে  অংশগ্রহণ করতে  অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন৷

অতঃপর পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত এলাকায় বসবাসকারী ভারতীয় সম্প্রদায়কে  জাতীয়তার নোতুন ভাবাদর্শে ও দেশপ্রেমে উদ্দীপিত করার জন্যে নেতাজী অক্লান্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন৷

১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে এক ঐতিহাসিক সমাবেশে তিনি সরকারীভাবে ‘‘আজাদ হিন্দ সরকার’’ এর  ঘোষণা করলেন৷ জাপান, জামার্নি, ইটালিসহ নয়টি রাষ্ট্র  এই অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল৷ এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়৷ এই  সরকার দুর্দমনীয় মনোবল নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করল  ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে৷ দুর্গম ও দুর্লঙ্ঘ্য এলাকার মধ্য দিয়ে বীরবিক্রমে আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালের ১৮ই মার্চ ভারতের মণিপুরের মাটিতে  স্বাধীন জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হল৷ এই সময়ে নেতাজী তাঁর সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন---           ‘‘রক্ত দিচ্ছে রক্তের ডাক৷ ওঠ, নষ্ট করার মত সময় আমাদের নেই৷ অস্ত্র তুলে নাও৷ ওই তোমাদের সামনে পড়ে রয়েছে পথ--- যে পথ তোমাদের পূর্বসূরীরা তৈরী করে গেছেন৷ ওই পথ বেয়ে আমরা এগিয়ে যাব৷ শত্রু সেনাবাহিনী ভেদ করে আমরা এগিয়ে যাব৷  তবে, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, আমরা শহীদের মৃত্যু বরণ করব৷ আমাদের শেষ নিদ্রায় আমরা সেই পথ  চুম্বন করবো, যে পথ দিয়ে  আমাদের মুক্তি ফৌজ দিল্লী পৌঁছাবে৷ দিল্লির পথ স্বাধীনতার পথ! চল দিল্লী৷’’

কিন্তু প্রকৃতির বিমুখতায় দিল্লি অভিযান থমকে দাঁড়াল৷ প্রচণ্ড বৃষ্টি, দ্রুত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তন, ইংরেজ বাহিনীর  ব্রহ্মদেশ পুণর্দখল ও ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে জাতীয় নেতৃত্বের  ঔদাসীন্য ও অসহযোগিতায় আজাদ হিন্দ সরকারের পতন হয়৷  দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও নেতাজী মনোবলকে ধরে রেখে আবার নোতুন করে  রসদ সংগ্রহের অভিপ্রায়ে প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলেন৷ কখনো  দীর্ঘ পাহাড়ী পথ হেঁটে, কখনো বোমারু প্লেনে চড়ে, কখনো সাবমেরিনে সওয়ার হয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পথে এগিয়ে চলতে লাগলেন৷

এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৫ সালের অগাষ্ট মাসে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা বর্ষণ করায়  মানব সমাজের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ধবংস ও জীবনহানি হলো৷ এর পরেই ১৯৪৫ সালের ১৪ই অগাষ্ট জাপান মিত্রপক্ষের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে৷ পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়দের প্রতি বিশেষ বার্র্তয় নেতাজী জানান---‘‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি  গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সবে শেষ হলো৷ সেই অধ্যায়ে পূর্ব এশিয়ার ভারত সন্তানেরা অমর আসন লাভ করবে৷ আমাদের সাময়িক ব্যর্থতায় হতাশ হইও না৷  পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নাই, যে ভারতবর্ষকে আর শৃঙ্খলিত করে রাখতে পারে৷’’

এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই ১৯৪৫ সালের ২৩শে অগাষ্ট  আচমকাই টোকিও রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয়, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ভারতবাসী তথা আপামর বাঙালী বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেননি৷ তাঁরা এ বিমান দুর্ঘটনাকে  সাজানো ও মিথ্যা প্রচার হিসেবে গ্রহণ করেন৷

পরবর্তীকালে খোসলা কমিশন, শাহনওয়াজ কমিশন, মুখার্জী কমিশন ইত্যাদি বিভিন্ন কমিশনের তদন্তও এই দুর্ঘটনাকে  সংশয়াতীতরূপে প্রমাণ করতে পারে নি৷ প্রকৃত পক্ষে সুভাষচন্দ্রকে দেশের মানুষের কাছে মৃত ঘোষণা করে  তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করাই ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী  ও দেশীয় শোষকশ্রেণী পঁুজিবাদীদের মুখ্য উদ্দেশ্য আর  এই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন উচ্চাকাঙ্খী, ক্ষমতালোভী, অবিমৃষ্যকারী কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ যাঁরা ইতোপূর্বে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন৷ তাঁদের আরও উদ্দেশ্য ছিল আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর সৈন্য ও নেতাদের মনোবল ভাঙা আর দেশবাসীর মন থেকে নেতাজীকে মুছে ফেলা৷ তাই রেনকোজি মন্দিরে সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম রক্ষিত আছে বলে যে প্রচার চালানো হয়েছে তা পৃথিবীর ঘৃণ্যতম ভাঁওতা ও ধাপ্পা ছাড়া কিছুই নয়৷ শুধু তাই নয়, স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীতে অন্যান্য প্রাদেশিক রেজিমেন্ট তৈরী হলেও ‘‘বাঙালী রেজিমেন্ট’’ নামে কোন রেজিমেন্ট নেই বা  আজাদ হিন্দ বাহিনীর ফৌজদের নিয়ে  কোন পৃথক রেজিমেন্টও গড়া হয়নি৷ আজাদ হিন্দ বাহিনীর সম্পত্তি ও অর্থ কোথায়, কিভাবে, কী পরিমানে,কার হেফাজতে রক্ষিত আছে-তারও প্রকৃততথ্য প্রকাশিত হয়নি৷ ভারতবর্ষের ক্ষমতালিপ্সু লোভী নেতৃবৃন্দ  দেশভাগের পরিবর্তে যে স্বাধীনতা হাত পেতে নিয়েছিল, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা৷  অথচ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্তরাধিকারী পঁুজিপতিদের কব্জায়৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পাওয়ার কুফল ভারতবাসীরা আজও সমানভাবে ভুগে চলেছে, শোষণের স্টীমরোলারের তলায়  চিড়েচ্যাপ্ঢা হয়ে৷

স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ সৈনিক ও স্বদেশ প্রেমের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন পর্যালোচনা করে আমরা পাই---         তিনি ছিলেন নৈতিকতার অতন্দ্র প্রহরী, আধ্যাত্মিকতায় দীপ্তিময়,আপোষহীন সংগ্রামী, দৃঢ়চেতা, সুদক্ষ সংঘটক ও উদার মানসিকতার মানুষ৷ তিনি কখনও কোনোরকম কুসংস্কার বা  চাপিয়ে দেওয়া মতবাদকে মেনে নেননি৷  তিনি কোন দয়ার দান বা ভিক্ষা হিসাবে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করতে চাননি--- তিনি বিশ্বাস করতেন শত্রু ও শোষককে সম্মুখ সমরে পরাজিত করেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ও সেই স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা--- আর এই স্বাধীনতা অবশ্যই হতে হবে পূর্র্ণঙ্গ স্বাধীনতা, কোনো শর্র্তধীন খণ্ডিত স্বাধীনতা কখনই কাম্য হতে পারে না৷ এইখানেই অন্যান্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ছিল তাঁর পার্থক্য৷  রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে সমর্থন করেননি, কারণ পঁুজিবাদী শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট দেশবাসী কখনই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ অবশ্য মার্ক্সীয় বস্তুতান্ত্রিক জড়বাদী সমাজতন্ত্রকেও ভারতীয় পরিবেশে প্রয়োগের তিনি ছিলেন বিরোধী৷ তিনি জানতেন ভারতবর্ষের কৃষ্টি, সংসৃকতি,ঐতিহ্য প্রোথিত রয়েছে সুদীর্ঘ কালের লালিত মৈত্রী,সম্প্রীতি ও আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিভূমিতে৷  ভারতবর্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞান,ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মানবমিলনের দেশ৷ তাঁর সমাজতন্ত্রের ভাবনা সম্পর্কে নেতাজী বলেছেন---‘‘সে সমাজতন্ত্র কালমার্ক্সের পুঁথি থেকে জন্ম নেয়নি, এর উৎপত্তি ভারতবর্ষের আপন চিন্তাধারা ও  সংসৃকতির মধ্যে৷’’ বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য আধ্যাত্মিকতার পূজারী নেতাজী উপলদ্ধি করেছিলেন যে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনপূর্ত্তির সুসমন্বয়ই শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ৷ মানুষের জাগতিক, মানসিক, ও আত্মিক ত্রিবিধ উন্নতির মাধ্যমে প্রকৃত সমাজ গড়ে উঠতে পারে৷ বর্তমান পৃথিবীতে  বিশেষতঃ ভারতবর্ষে যে ধরণের সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চলছে-এই পরিস্থিতিতে  নেতাজীর আদর্শ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক৷ মানুষে মানুষে হানাহানি, হিংসা, অসম্মান দুর্নীতি,ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত ইত্যাদি সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা ও  বিদ্বেষের পরিবেশ বর্তমানে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে৷ এর ফলে মানুষের পরিবার, সমাজ, দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে৷ মানুষ সামাজিক জীব--- এককভাবে কেউ বাঁচতে পারে না৷ তাই সকলকে মিলে মিশে  সমাজ ও দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে, যার মূলে থাকবে আধ্যাত্মিকতার চালিকা শক্তি---এই নীতিকেই নেতাজী তার সমাজ গঠনের মূলমন্ত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন৷

নেতাজী তাঁর ‘‘তরুণের স্বপ্ণ’’গ্রন্থে লিখেছেন ---‘‘বঙ্গ জননী একদল নবীন সন্ন্যাসী চান৷ ভাই সকল, কে তোমরা আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত আছ, তোমরা এসো, তোমাদের সকলের প্রয়োজন আছে৷ মায়ের হাতে পাবে তোমরা দুঃখ-দৈন্য,ক্লেশ, কারাযন্ত্রণা৷ এসব যারা নীরবে নীলকন্ঠের মত সহ্য করতে পার, তারাই এসো৷’’

অর্র্থৎ দেশ জননীর জন্যে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের সংকল্পই  তিনি তরুণদের সামনে আদর্শরূপে তুলে ধরেছেন৷ নেতাজীর আদর্শে সমাজ নির্র্মণ করতে হলে যেটা সর্র্বগ্রে প্রয়োজন তা হলো প্রকৃত মানুষ তৈরী করা যাঁদের আধ্যাত্মিকতার মান হবে অতি উচ্চ ও যাঁরা ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ সেবার জন্যে সদা প্রস্তুত৷ বর্তমানে যেসব নেতা নেত্রীর দ্বারা সমাজ পরিচালিত তারা সকলেই সুবিধাবাদী, দলসর্বস্ব মানসিকতা সম্পন্ন৷ দল ও নিজের স্বার্থ ছাড়া দেশবাসীর সুখ সুবিধা বোঝার সামর্থ্য, ঔদার্য্য বা বৌদ্ধিক প্রাখর্য্য তাদের নেই৷ রাজনৈতিক দলগুলিও আদর্শহীন, নৈতিকতাহীন ও যেন তেন প্রকারেন ক্ষমতা লাভের অভিলাষী৷ এমতাবস্থায় এমন একটা সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন প্রয়োজন যা শোষিত বঞ্চিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা দুর করতে সমর্থ৷ নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের জীবনদর্শনও  এই আদর্শের অনুসারী৷ আর এই আদশই মূর্তরূপ পেয়েছে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রাউট দর্শনের মধ্যে৷

সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন ‘প্রাউট’ বা ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ এর ভিত্তিভূমি হলো আধ্যাত্মিকতা যা ছিল নেতাজীর সমাজচিন্তার মূল উপজীব্য৷ প্রাউট দর্শন অনুযায়ী বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সৃষ্টিকর্তা পরমব্রহ্ম ও তিনিই সকল সম্পদের মালিক৷ জীব-জড়-উদ্ভিদ-মানুষ সকলেই তাঁর সৃষ্টি ও সন্তান সন্ততি৷ সুতরাং পৃথিবীর সমস্ত সম্পদে সকলের ভোগদখলের অধিকার রয়েছে৷ কেউ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করে তবে অন্যেরা বঞ্চিত ও শোষিত হতে বাধ্য৷ প্রত্যেকের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির ব্যবস্থা করতে হবে ও বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাহায্যে সকল সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে৷ মানুষের চাহিদা অসীম ও এই অসীম চাহিদা সীমিত জাগতিক সম্পদের দ্বারা মেটানো অসম্ভব৷  তাই মানুষের অনন্ত চাহিদাকে অনন্ত মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে চালিত করতে হবে বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে৷ আধ্যাত্মিকতার পথেই মানুষের মন হবে শান্ত ও তৃপ্ত---মনের লোভ, হিংসা ও দুর্নীতি ক্রমশঃ কমতে থাকবে৷ ফলে  সমাজে অন্যায় অবিচার ও শোষণ কমে যাবে৷

শুধুমাত্র মানুষই নয়,নব্যমানবতাবাদের প্রয়োগে উদ্ভিদ, প্রাণীজগৎ ও জড়ের উন্নতি বিধানেও মানুষের প্রজ্ঞাকে  কাজে লাগাতে হবে৷  কারণ, মানুষের অস্তিত্ব উদ্ভিদ, অন্যান্য প্রাণী ও জড়ের ওপর নির্ভরশীল৷ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি পরমপুরুষের সন্তান---এই আদর্শে উদ্বোধিত হয়ে সমগ্র পৃথিবীর জীব জড় উদ্ভিদকে ভালবাসতে পারলে পৃথিবী থেকে হিংসা, দ্বেষ,ভেদাভেদ,হানাহানি দূর হয়ে প্রকৃত শোষণহীন সমাজ গড়ে উঠবে৷ এই সমাজের নেতৃত্বে থাকবেন আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত,বলিষ্ঠ চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যষ্টিগণ যাঁদের বলা হয় সদবিপ্র৷ নেতাজীর আদর্শও ছিল  এইরকম নীতিবাদী, আপোষহীন, সত্য ও ন্যায়ের উপাসক ব্যষ্টিগণের দ্বারা পরিচালিত শোষণহীন মানব সমাজ গঠন৷ তাই নেতাজীর আদর্শকে অনুসরণ করে শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে একমাত্র সমাধান প্রাউট দর্শন ও নব্যমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷ আর প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সাধনা সেবা ও ত্যাগের মাধ্যমে এই কাজকে তরান্বিত করতে এগিয়ে আসতেই হবে৷ তখনই দেশনায়ক মহান বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্ভব ও ২৩শে জানুয়ারীতে ‘নেতাজী  জয়ন্তী’ উদ্যাপন সার্থক হবে৷

সহায়তা গ্রহণ ঃ---

বাংলা ও বাঙালী - শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার,

আমি সুভাষ বলছি - শ্রী শৈলেশ দে,

অনির্র্বণ জ্যোতি  - শিশির কুমার বসু

ও অন্যান্য পুস্তকাদি৷