(প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচনা সম্ভার থেকে সংগৃহীত)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এই ব্যবস্থার বিপরীতে বেশ কিছু দেশ ও রাজ্যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে যার নেতৃত্বে রয়েছে কমিউনিষ্টগণ কিন্তু এই সমাজ ব্যবস্থাতেও প্রকৃত নেতৃত্ব থাকে পলিটব্যুরোর গুটিকয়েক নেতৃস্থানীয় ব্যষ্টির হাতে কমিউনিষ্ট ব্যবস্থায় সর্বহারা নেতৃত্বের কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রশাসক হিসেবে যারা নির্বাচিত হন তারা কেউই সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত নন তাছাড়া কমিউনিষ্ট শাসন ব্যবস্থাও নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার কারণে সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিদের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে থাকে ও প্রশাসকগণ ধীরে ধীরে পুঁজিপতিদের হাতের পুতুলে পরিণত হয় তাই এই শাসনব্যবস্থাও প্রচ্ছন্ন পুঁজিবাদী শাসনেরই নামান্তর ও পুঁজিবাদের সর্বপ্রকার ত্রুটিযুক্ত ফলে ওপরে বর্ণিত সবক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ওপর পুঁজিবাদী শোষণের ষ্টীম রোলার সমানেই চলতে থাকে মানুষের সর্ববিধ শোষণমুক্তির জন্যেই প্রাউট দর্শনে সদ্বিপ্র নেতৃত্বের কথা বলা হয়েছে সদ্বিপ্র সম্বন্ধে প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন---
যম-নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সুসংবদ্ধ চিন্তাধারা, সুপরিকল্পিত কার্যপ্রণালীর ভিত্তিতে মানব জাতির দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরণের জন্যে যাঁরা সর্বদা সচেষ্ট, সেই সব আধ্যাত্মিক বিপ্লবীরাই হচ্ছেন সদ্বিপ্র।
সদ্বিপ্র নিষ্ক্রিয় সাক্ষীগোপাল নয় কোন ব্যষ্টি অথবা শ্রেণী যাতে অন্যদের ওপর শোষণ করতে না পারে সেজন্য সদ্বিপ্ররা থাকবে সদা তৎপর এই কারণে সদ্বিপ্রদের হয়তো স্থূলশক্তি সম্প্রয়োগও করতে হতে পারে, কারণ তাদের লড়তে হবে সেই শক্তি-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যারা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে যেক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় শ্রেণী শোষক হয়ে উঠেছে, সেক্ষেত্রে সদ্বিপ্রদের স্থূলশক্তির সাহায্য নিতে হতে পারে বিপ্রযুগে যখন বিপ্ররা শোষণের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চলেছে তখন বিপ্লব আনতে হবে বৌদ্ধিক জগতে আর যেহেতু গণতান্ত্রিক সংরচনা বৈশ্যদের পুঁজির পাহাড় সৃষ্টি করতে সাহায্য করে সেজন্যে গণতন্ত্রের সাহায্যেই বৈশ্য শ্রেণীর শাসন চলতে থাকে আর তাই এই বৈশ্য শোষণের যুগে সদ্বিপ্রদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হওয়ার কৌশল অর্জন করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিতে পারে --(কণিকায় প্রাউট, ৩য় খণ্ড)।
সুদূর অতীতে যখন মানুষের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি তখন সকলেই কায়িক শ্রমের ওপরেই নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত এই সময়কে আমরা শূদ্রযুগ নামে অভিহিত করতে পারি সময় যত এগিয়ে যেতে লাগল, মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে মুষ্টিমেয় কিছু সাহসী মানুষ এগিয়ে এল তারা তাদের শারীরিক সামর্থ্য,তেজ ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের কৌশলের দ্বারা জনগণের সুরক্ষা ও সমাজের নেতৃত্ব দিতে লাগল এদের বলা হয় ক্ষত্রিয় সময়ের বিবর্তনে সমাজ এই সব ক্ষত্রিয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে উঠল, বিবিধ প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ এদের শরণাপন্ন হল---আর এইসব ক্ষত্রিয়দের প্রভাব প্রতিপত্তিও গেল বেড়ে এই সময়কালকে আমরা বলতে পারি ক্ষত্রিয় যুগ সময়ের অগ্রসরণে যুদ্ধবিগ্রহ, শাসনকার্য পরিচালনা ইত্যাদির জন্যে নূতন নূতন অস্ত্রের প্রয়োজনে, কূটবুদ্ধি প্রয়োগের উদ্দেশ্যে, সমরকৌশলকে উন্নত করার কারণে বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে উন্নত মানুষজনকে এগিয়ে আসতে হল ক্রমে ক্রমে ক্ষত্রিয়েরা এই সকল উন্নত মেধার বিপ্রগণের শরণ নিতে বাধ্য হল এর ফলে বিপ্রযুগের সূচনা হল বিপ্রদের সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়, শূদ্রদের ভূমিকা থাকলেও অর্থবলের কারণে বৈশ্য বা পুঁজিপতিরা পাদপ্রদীপের আলোয় এসে গেল পরবর্তী পর্যায়ে এই বৈশ্যগণ তাদের আর্থিক ক্ষমতার দ্বারা সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলল ক্রমে শাসন ব্যবস্থা তাদের নির্দেশেই চালিত হতে লাগলো ও সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ, নিপীড়ণ, বঞ্চনার কষাঘাত চলতে থাকল ক্রমশঃ সমাজের অন্যান্য শ্রেণী যথা শূদ্র, বিপ্র, ক্ষত্রিয় সকলেই বৈশ্যদের শাসনে ও শোষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে গেল বর্তমান যুগে সমগ্র পৃথিবীতে এই অবস্থারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এই শোষিত, নিপীড়িত শূদ্রদের মধ্যে যারা ক্ষাত্র ও বিপ্র মনোভাবাপন্ন তারা শেষ পর্যন্ত শোষণমুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে আসতে বাধ্য হল এদেরই বলা হয় বিক্ষুব্ধ শূদ্র এই বিক্ষুব্ধ শূদ্ররাই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ চক্রের পরবর্তী ঘূর্ণনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ক্ষত্রিয় যুগের শুভসূচনা ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
প্রাউট প্রবক্তার ভাষায়---
বিপ্লবের অগ্রদূত ক্ষাত্রবুদ্ধি বা বিপ্রবুদ্ধি সম্পন্ন শূদ্ররা মধ্যবিত্ত হতেও পারে, নাও হতে পারে সেক্ষেত্রে আমি এই ধরণের বিপ্লবী শূদ্রদের জন্যে মধ্যবিত্ত শব্দটির পরিবর্তে বিক্ষুব্ধ শব্দটি ব্যবহার করতে রাজী আছি এই বিক্ষুব্ধ শূদ্র সমাজ অত্যাচারী বৈশ্যের চক্ষুশূল শ্রমিক বিক্ষোভকে আসলে পুঁজিপতিরা ভয় পায় না---এরা ভয় পায় শ্রমিক নেতা এই সকল বিক্ষুব্ধ শূদ্রকে।
যাঁরা বিপ্লবের অগ্রদূত সেই ক্ষাত্রবুদ্ধি বা বিপ্রবুদ্ধি শূদ্রকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে, যথোপযুক্ত ভাবে বিপ্লবের পাঠ নিতে হবে, চরিত্র গড়তে হবে, নীতিবাদী হতে হবে অর্থাৎ এককথায় আমি যাদের সদ্বিপ্র বলি তা হতে হবে যারা এই ধরণের কঠোর আদর্শনিষ্ঠ সদ্বিপ্র তারাই হবে বিপ্লবের বার্তাবহ ধরিত্রীর প্রতিটি গৃহকোণে মানব অস্তিত্বের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় বিপ্লবের বাণী এরাই পৌঁছে দেবে বিপ্লবের বিজয়-কেতন থাকবে শুধু এদেরই হাতে।
সমাজ চক্রের পরিঘূর্ণন কেউই বন্ধ করতে পারে না, সদ্বিপ্ররাও পারে না সদ্বিপ্ররা সমাজচক্রের চক্রনাভিতে অধিষ্ঠিত থেকে ঘূর্ণন ক্রিয়ার ওপরে সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলবে ক্ষত্রিয়ের পর বিপ্র, বিপ্রের পরে বৈশ্য---একের পর এক যুগ আসতেই থাকবে সদ্বিপ্র তা আটকাতে পারবে না, তবে বিপ্লবোত্তর ক্ষাত্রযুগের প্রতিষ্ঠার পরে তার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে যেন ক্ষত্রিয় সমাজের প্রতিভূ হিসাবে কেবলমাত্র শাসনই করে যায়---শোষণের ভূমিকায় নামতে না পারে।
আজ প্রতিটি যুক্তিনিষ্ঠ ধার্মিক, নীতিবাদী সংগ্রামী মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, তাঁরা যেন অনতিবিলম্বে একটি সুষ্ঠু সদ্বিপ্র সমাজ গড়ে তোলেন এই সদ্বিপ্রদের কাজ করতে হবে সর্বদেশের জন্যে, সকল মানুষের সর্বাত্মক মুক্তির জন্যে লাঞ্ছিত পৃথিবীর ভূলুণ্ঠিত মানবতা তাঁদের আগমনের প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে পূর্ব আকাশের দিকে চেয়ে আছে তাঁদের সামনে থেকে অমানিশার অন্ধতমিস্রা কেটে যাক, নতুন সূর্যোদয়ে নূতন দিনের মানুষ নূতন পৃথিবীতে জেগে উঠুক
(কণিকায় প্রাউট ষষ্ঠ খণ্ড, মানুষের সমাজ, দ্বিতীয় খণ্ড)
চক্রকেন্দ্রে সদ্বিপ্রাঃ চক্রনিয়ন্ত্রকাঃ--- অর্থাৎ সমাজচক্রের মূল কেন্দ্রে সদ্বিপ্রগণ অবস্থান করে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন যাতে কোন শ্রেণীই কখনোই শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে না পারে আর যদি সেই অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে যথোচিত শক্তি সম্প্রয়োগের দ্বারা সদ্বিপ্রগণ বিপ্লব ঘটিয়ে পরবর্তী যুগের সূচনা করবেন এই সকল আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, আপোষহীন সংগ্রামী, নিরলস কর্মী, নীতিবাদী সদ্বিপ্রের নেতৃত্বে প্রকৃত শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে ও নব্যমানবতার পথে জীব, জড়, উদ্ভিদ সকলের জন্যে একটি সুন্দর মহাবিশ্ব রচিত হবে।
- Log in to post comments