সিএবি-তে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে হিন্দু বাঙালীরা

লেখক
শঙ্কর দাশ

সোমবার (৯ই ডিসেম্বর ২০১৯) লোকসভা ও মঙ্গলবার রাজ্যসভায় সিএবি সংক্ষেপে ক্যাব পাশ হয়ে গেল ও বৃহস্পতিবার (১২ই ডিসেম্বর) রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলে ক্যাব বিলটি আইনে পরিণত হয়ে গেল৷ এরই মধ্যে ক্যাবের বিরোধিতা করে অসম রাজ্যে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ সরকার গুলি চালিয়ে তিনজনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে এমনই পরিস্থিতি৷ আহত কয়েকজন হাসপাতালেও মারা গেছেন৷ পশ্চিমবঙ্গও উত্তাল৷ ত্রিপুরা রাজ্যের পরিস্থিতিও তথৈবচ৷ যদিও গুলি করে হতাহত করার খবর নেই৷ তবুও ক্যাব বিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘ত্রিপুরা বন্ধ’ আর ‘রেল অবরোধ’ প্রভৃতি কারণে একজন শিশু সহ দু’জনের মৃত্যু হয়েছে৷ অসমে বিশেষ করে অবাঙালী সম্প্রদায় ক্যাবের বিরোধিতা করছে৷ ত্রিপুরাতেও অবাঙালী সম্প্রদায়ের মানুষেরাই ক্যাবের বিরোধিতা করছেন৷ বাঙালীরা চুপ করে আছেন৷ তবে সবচেয়ে বেশী চুপ করে আছেন হিন্দু বাঙালীরা৷ কয়েকজন বাঙালী হিন্দুর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, ক্যাবের বিরোধিতা তারা করবে না৷ কেন, জিজ্ঞেস করলে খুশী মনে উত্তর দিলেন ক্যাবে নাকি স্পষ্ট বলা আছে ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বারবার বলছেন ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের আগে বাঙলাদেশ, আফগানিসত্মস্তান ও পাকিস্তান থেকে অমুসলিম (মুসলমান নয় অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, জৈন প্রভৃতি সম্প্রদায়) ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছেন তারা নাগরিকত্ব পাবেন৷ শর্ত হিসেবে তাদেরকে ভারতে কমপক্ষে পাঁচ বছর বসবাস করতে হবে৷ এরপর নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারবেন৷ এই খুশীতেই তারা ক্যাবের বিরোধিতা যেমন করতে চান না তেমনি যারা ক্যাবের বিরোধিতা করেন উল্টে তাদেরই বিরোধিতা করতে থাকেন খুশীতে মশগুল হওয়া হিন্দুগণ৷ কিন্তু ক্যাবে যে বলা আছে মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে বাঙলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ত্যাগ করার কথা৷ এই ফাঁকটিই তারা বুঝতে পারছেন না৷ তাই তারা নাগরিকত্ব পাবেন কিনা সেটাই মূল প্রশ্ণ৷ কেন? কারণ ক্যাবের শর্তানুসারে আপনি বা আপনার পুর্বপুরুষ যে বাঙলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন তার কি কোন প্রমাণ আছে আপনার হাতে? অর্থাৎ কি না আপনি বা আপনার পূর্ব পুরুষ যে ওই দেশগুলোতে মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন ওই দেশের স্থানীয় থানায় কি কোন এফ.আই.আর. করেছেন? সেই এফ.আই.আর.-এর কপি কি আপনাদের হাতে আছে? বা আপনাদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচারের খবর পত্রিকায় যে প্রকাশিত হয়েছে সেই পত্রিকার কপি কি আছে আপনাদের হাতে? নেই? তাহলে জেনে রাখুন আপনি বহিরাগত তথা অনুপ্রবেশকারী৷ আপনার স্থান ক্যাবের আওতায় নয়, ডিটেনশন ক্যাম্পে৷ সুতরাং ক্যাব কোন হিন্দুকেই বাঁচাবে না৷ কেউ কেউ বলে বেড়ান হিন্দুরা ওই সব দেশগুলেতে অত্যাচারিত হয়েছে---এই দাবী করলেই ক্যাব হিন্দুকে বাঁচিয়ে দেবে৷ প্রশ্ণ আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  বার বার অসংখ্যবার বলে যাচ্ছেন কোনও অনুপ্রবেশকারীকেই ‘ঘুসপেটিয়া’ এদেশে থাকতে দেওয়া হবে না৷ সবাই যদি দাবী করেন যে আমি অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসেছি, তাহলে অনুপ্রবেশকারী কে? কোন অনুপ্রবেশকারীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ দেশ থেকে তাড়াবেন? এখনও বুঝতে পারছেন না ক্যাব অনুসারে প্রত্যেকটা হিন্দু বাঙালী টার্গেটে পড়ল৷ আপনি ভাবছেন---এটা মুসলমানকে টার্গেট করা হয়েছে৷ ভুল, আপনি ভুল৷ ত্রিপুরাতে একজনও মুসলমান আছেন কি না সন্দেহ আছে যিনি  বাঙলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করে ত্রিপুরাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন৷ বরং অজস্র মুসলমান এক্সচেঞ্জ করে ত্রিপুরা থেকে বাঙলাদেশে চলে গেছেন৷ তা সবাই জানেন৷ সুতরাং এটা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, সম্পূর্ণত বাঙালী হিন্দুদের বিরুদ্ধে৷ অতএব বুঝতেই পারছেন, আপনাকে অবশ্যই মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে আসারপ্রমাণপত্র দিতেই হবে৷ তা না হলে আপনি অনুপ্রবেশকারী তথা ঘুসপেটিয়া৷ একটু আগেই বললাম, অনুপ্রবেশকারীর স্থান কোথায়? এখনও বুঝলেন না? তবে আর একটু পরিষ্কার করি৷ কীসের ভিত্তিতে প্রমাণ করবেন আপনি একজন হিন্দু?  আপনি তো একজন মুসলিমও হতে পারেন৷ এখানে এসে নাম পাল্টে ফেলেছেন, আবারও বলছি ঠিক সেই জন্যে আপনাকে ওই দেশে অত্যাচারিত হওয়ার প্রমাণ দেখাতেই হবে৷ কী বললেন? এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না৷ তাহলে তো আপনি গেলেন৷

এবার আর একটি বিষয় দেখুন৷ যেই মাত্র আপনি বাঙলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে এই দেশে এসেছেন ক্যাব অনুসারে ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন বলে দাবী করে লিখিত আবেন করেছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে আপনি লিখিতভাবে প্রমাণ করে দিলেন আপনি অনুপ্রবেশকারী তথা বহিরাগত৷ তৎসঙ্গে সরকার স্বীকৃত ও অনুমোদিত আপনার ভোটার কার্ড গেল, আধার কার্ড গেল, প্যান কার্ড গেল, রেশন কার্ডও গেল৷ সুতরাং আপনার চাকরীও গেল৷ আপনার ব্যাঙ্কের টাকাও গেল, ব্যবসা গেল৷ কম পয়সায় সরকারী চিকিৎসার সুযোগও গেল৷ ছেলেমেয়ের পড়াশোনা গেল৷ কারণ আপনি ঘোষণা করেছেন আপনি একজন বিদেশী নাগরিক৷ তাহলে ক্যাব নিয়ে হিন্দু বাঙালীদের প্রফুল্ল চিত্ত হওয়ার কোন কারণ দেখছি না৷ অর্থাৎ ক্যাব আপনাকে ফাঁসিয়ে দিল৷ এবার কী করবেন? ধরে নিন, আপনার জন্যে ক্যাব আইন প্রযোজ্য হবে না৷ সুদূর অতীত থেকেই আপনি ভারত ভূখণ্ডে আদি অধিবাসী৷ তাহলে এবার আপনাকে এন.আর.সি. ধরবে ৷ এখন পর্যন্ত যতটুকু খবর ১৯৫১ সালের ভিত্তি ধরেই এনআরসি. হবে৷ ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষ রয়ে গেছেন আমি পুরো ভারত ছেড়ে দিলাম, বাঙালী অধূ্যষিত অঞ্চলেই কোটি কোটি বাঙালী রয়ে গেছেন৷ যাদের ১৯৫১ কেন, ১৯৭১ সালেরই কোন কাগজপত্র নেই৷ হয়ত হাজার বছর ধরেই এখানকার আদি বাসিন্দা৷ তাদের কাগজপত্র না থাকার পিছনে অনেক কারণও আছে৷ কারণ যাই থাক ১৯৫১ সালের কাগজপত্র না দেখাতে পারলে আপনি এন আর সি থেকে বাদ পড়বেন৷ এবার কোথায় যাবেন? ক্যাব বলুন আর এন.আর.সি. বলুন, উভয়তেই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে হিন্দু বাঙালীরাই৷ মুসলমান সম্প্রদায় ইতোপূর্বেই তা বুঝে গেছেন৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ত্রিপুরার হিন্দু বাঙালীরাই এখন ঘুমিয়ে আছেন৷ অথচ তারাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ যেদিন ক্যাবের আঁচ তাদের গায়ে লাগবে সেদিন হয়তো নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে অনেক দেরী হয়ে যাবে৷ বাঙালী এখনও সময় আছে বোঝার চেষ্টা করুন---হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হোন৷