সম্প্রতি কলকাতার সেন্ট পলস্ কলেজে ছাত্র সংসদের এক পদাধিকারীকে নগ্ণ করে হেনস্থা করা হয়েছে ও সেই ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ যারা হেনস্থা করেছে ও যাকে হেনস্থা করা হয়েছে , সবাই তূণমূল ছাত্রপরিষদের পদাধিকারী৷ হেনস্থাকারীদের মধ্যে অশিক্ষক কর্মী ও বহিরাগত টিএমসিপি সদস্যও রয়েছে বলে অভিযোগ৷
স্কুল কলেজ মানুষ তৈরীর কেন্দ্র৷ বলা চলে মানুষ তৈরীর কারখানা৷ এখানে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা হওয়া মানে শিক্ষাকেন্দ্রের ‘মানুষ তৈরীর যে ব্রত’ সে ব্রত ভণ্ডুল হয়ে যাওয়া৷ শুধু অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা বললেই যথেষ্ট নয়, শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে যা চলছে এইভাবে নগ্ণ করে হেনস্থা, মারপিট,খুন-জখম, এতে ‘শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর তৈরী হচ্ছে’৷
ব্যাপারটা যে শুধু বর্তমানকার বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা নয়, বামফ্রন্ট আমলে তো এর চেয়ে বহুগুণ খারাপ অবস্থা ছিল৷ কংগ্রেস আমলেও ধোয়া তুলসী পাতা ছিল না৷
আসল কথা, শিক্ষা কেন্দ্রগুলি তার নীতি থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গেছে৷ তার সব থেকে বড় কারণ হ’ল শিক্ষার পরিচালনা ব্যবস্থার ত্রুটি৷ শিক্ষাকেন্দ্রগুলির পরিচালন ব্যবস্থা থাকা উচিত প্রকৃত শিক্ষাবিদ্দের সমবায়ে তৈরী বোর্ডের হাতে৷ শিক্ষাকেন্দ্রগুলির সমস্ত কিছুরই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা উচিত তাঁদেরই হাতে৷ কিন্তু তার পরিবর্তে সরকারের ওপর এর নিয়ন্ত্রণভার ৷ বর্তমান প্রচলিত গণতন্ত্রের সুবাদে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনার ক্ষমতা অর্জন করে৷ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে শিক্ষাকেন্দ্রগুলিও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে৷ দেখা যাচ্ছে, যিনি শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাবিভাগের ওপর ছড়ি ঘোরানোর পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী, তিনি হয়তো শিক্ষার কিছুই বোঝেন না৷ যেমন, বিহারে একসময় মুখ্যমন্ত্রী রূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন এমন একজন যিনি প্রাইমারী স্কুলের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে হাইস্কুলে পড়ারই যোগ্যতা অর্জন করেননি৷ তাঁর ওপর ওই রাজ্যের সমস্ত বিভাগের নিয়ন্ত্রণভার ছিল৷
শিক্ষিত হলেই বা কী? এখন গণতন্ত্র হ’ল জনগণের সেবা নয়, মুখ্যতঃ ক্ষমতা দখলের রাজনীতি৷ যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা করায়ত্ত করতে হবে, ক্ষমতা করায়ত্ত একবার হয়ে গেলে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে৷ এইটাই একমাত্র নীতি৷ অন্য সব ‘নীতি’ সেখানে একেবারেই গৌণ, বলতে গেলে অস্তিত্বহীন৷ তখন জোর যার মুলক তার৷ পদের জোর, খঁুটির জোর, পয়সার জোর--- সবকিছুই সেখানে সমার্থক৷
শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতেও একই নিয়ম চলে৷ তাহলে কি শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যে আস্ত থাকে? না---তাও বিকৃত হয়ে যেতে বাধ্য৷
বর্তমানে বিশেষ করে কলেজগুলিতে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তার মূল কারণ কিন্তু এইটাই৷ এটাই সমস্যার গোড়া৷ এই সমস্যার সমাধান না করে যতই কিছু করা হোক না কেন--- কমিটি, কমিশন, আদালত, আইনসভা বা সংসদে বিতর্ক--- কোনো কিছুতেই সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবার নয়৷ কুকুরের লেজের মত৷ টেনে ধরে আবার ছেড়ে দিলে যেই কে সেই৷ মূল স্বভাবের পরিবর্তন করতে হবে৷ অর্থাৎ মূলনীতির পরিবর্ত্তন করতে হবে৷ তবে সমাধানের প্রকৃত রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে৷ তা না করে সমস্যা সমাধানের জন্যে হৈচৈ করা মানে হ’ল, জেনে শুণে অভিনয় করা৷ সমস্যাকে সাময়িক ভাবে ধামা চাপা দিয়ে রেখে অন্যদের বিভ্রান্ত করা৷ সাপকে ধামা চাপা দিয়ে রাখার মতো৷
শিক্ষার মতো জাতির মেরুদণ্ড তৈরীর যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতিষ্ঠান এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে, শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে যথার্থ মানুষ তৈরীর কারখানা হিসেবে রাখতে হলে,--- এর পরিচালনার মূলনীতির পরিবর্তন করতে হবে৷ অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ চলবে না৷ শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ভার সম্পূর্ণ রূপে নিরপেক্ষ শিক্ষাবিদদের হাতে রাখতে হবে৷ তবে শিক্ষাকেন্দ্রগুলির পরিচালনার অর্থের জোগান দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের৷ কোনো কোনো মন্ত্রীকে বলতে শোণা গিয়েছিল, সরকার যখন টাকা দেবে, তখন পরিচালনা করার দায়িত্বে তাদের হাতে থাকবে না কেন? সরকার মানে মন্ত্রীরা তাদের বাপের টাকা শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে দিচ্ছে না, জনগণ যে টাকা ট্যাক্স হিসাবে তাদের কাছে দিচ্ছে, সেই টাকা থেকেই সরকার শিক্ষাকেন্দ্রগুলির পরিচালনার টাকা দিতে বাধ্য৷ এটা তাদের ডিউটি৷ কিন্তু শিক্ষা-ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের নয়, এ দায়িত্ব শিক্ষাবিদদের৷ স্কুল-কলেজগুলির সিলেবাস তৈরী করা থেকে আরম্ভ করে পরীক্ষা নেওয়া, কলেজের ইয়ূনিয়ন সহ যাবতীয় ব্যাপার দেখা, যাবতীয় নিয়ম-নীতি নির্র্ধরণ করা, বিশৃঙ্খলা হলে বিশৃঙ্খলাকারীদের বা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া--- এ সমস্ত কিছুর পূর্ণ দায়িত্ব শিক্ষাবিদদের দিয়ে তৈরীবোর্ডের হাতে থাকবে৷ সরকারের সেখানে নাক গলানোর কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়৷
- Log in to post comments