শিক্ষানীতি

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

প্রাউট অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হ’ল–‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’’৷ শিক্ষা হ’ল তাই যা বিমুক্তি অর্থাৎ স্থায়ী মুক্তি প্রদান করে৷ শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হ’ল ত্রিভৌমিক বিকাশ–মানবীয় অস্তিত্বের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিনস্তরেই একসঙ্গে ও সমানভাবে উন্নতি৷ এর ফলে ব্যষ্টিত্বের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি সংসাধিত হয়৷ এই শিক্ষা প্রসুপ্ত মানবীয় সম্ভাবনাকেও জাগিয়ে তোলে যাতে করে তার যথার্থ উপযোগ সম্ভবপর হয়৷ প্রকৃত শিক্ষিত তাকেই বলব যিনি প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছেন, তা অনেক বেশী মনে রেখেছেন ও নিজের বৈবহারিক জীবনে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন৷

প্রাউটের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ও আদর্শমুখীনতার ওপর জোর দিতে হবে৷ শিক্ষার সমস্ত স্তরে নৈতিক অনুশীলনকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে৷ শিশুর মনে প্রথম থেকে বিশ্বৈকতাবাদের ভাবনাও সঞ্চারিত করতে হবে৷ শুধু শিষ্টাচার আর মার্জিত ব্যবহার শিখিয়ে দিলে চলবে না৷ সত্যিকারের শিক্ষা হ’ল তাই যা শিক্ষার্থীর মনে সৃষ্টির সব অস্তিত্বের প্রতি গভীর ভালবাসা ও মমত্বৰোধকে জাগিয়ে তোলে৷

আজকের শিশু কালকের সুনাগরিক৷ শিশুর গ্রহণ ক্ষমতা তথা সর্জনশীলতা অসাধারণ কিন্তু তা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তোলার জন্যে শিক্ষা পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷

প্রাথমিক স্তরে শিশুকে তিনটি ভাষার শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে–নিজের মাতৃভাষা তথা স্বাভাবিক ভাষা, বেসিক সংস্কৃত বা উপযুক্ত ক্লাসিক্যাল ভাষা আর বিশ্বভাষা৷ নিজের মাতৃভাষার ইতিহাস শিশুকে জানতে হবে৷ আর বিশ্বভাষা শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র–ছাত্রারা নিজেদেরকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে ভাবতে শিখবে৷

প্রাউটের নীতি হচ্ছে মাতৃভাষা ছাড়াও মানুষ অন্যান্য ভাষা যত শিখতে পারে ততই ভাল৷ কিন্তু বাস্তব জীবনে সরকারী–বেসরকারী কাজে ও অফিস–আদালতে মাতৃভাষাই ব্যবহূত হওয়া উচিত৷ মাধ্যমিক স্তরে (ভারতে অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণী) ছাত্র–ছাত্রাদের স্বাভাবিক প্রবণতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে৷ দরিদ্র অথচ প্রতিভাধর ছাত্র–ছাত্রাদের জন্যে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরে এই ধরনের ছাত্র–ছাত্রাদের জন্যে সরকারী আর্থিক সহায়তায় গবেষণামূলক কাজের সুযোগ করে দিতে হবে৷

পরীক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে যাতে করে শিক্ষার্থীর তত্ত্বগত ও বৈবহারিক জ্ঞান এই দু’য়েরই সঠিক মূল্যায়ন হয়৷ স্কুলে থাকাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীকে সমাজকল্যাণমূলক ও অন্যান্য ঘটনমূলক (constructive) কাজে নিয়োজিত হবার জন্যে প্রোৎসাহিত করতে হবে৷ শিক্ষান্তে যথোপযুক্ত জীবিকার নিশ্চিততাও থাকতে হবে৷

শিক্ষক নির্বাচন করতে হবে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে৷ এজন্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে সার্টিফিকেট বা প্রশংসাপত্র যথেষ্ট নয়৷ চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, সমাজসেবা, নিঃস্বার্থপরতা, অনুকরণীয় ব্যষ্টিত্ব ও স্বভাবসুলভ নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা–শিক্ষকের এইসব যোগ্যতা অবশ্যই থাকতে হবে৷ সমাজে শিক্ষক সর্বোচ্চ সন্মান পাবেন আর তাদের আর্থিক দায়ভার সমাজকেই বহন করতে হবে৷

শিক্ষানীতি নির্দ্ধারণ, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষাসম্বন্ধীয় অন্যান্য কার্যধারা স্থির করার ব্যাপারগুলি যথাযোগ্য শিক্ষাব্রতী দ্বারা গঠিত বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হওয়া উচিত৷ তাদের কর্তব্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে এই বোর্ডের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকা উচিত৷ সমগ্র শিক্ষাক্ষেত্র সবরকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকা উচিত৷ সর্বস্তরে শিক্ষাকে অবৈতনিক করতে হবে৷

এখন একটি প্রশ্ণ ওঠে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রাউট সমর্থন করে কিনা বয়ঃপ্রাপ্ত ছাত্র–ছাত্রারা পঠন–পাঠন বহির্ভূ ত (non-academic) বিষয়ে সংযুক্ত থাকতে পারে৷ কিন্তু (academic) বিষয় সম্পূর্ণভাবে শিক্ষাব্রতীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত৷ অবশ্য এ ব্যাপারে তারা প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র–ছাত্রাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিতে পারেন৷ ঠিক যেমন পরিবার চালানোর ব্যাপারে ছেলেমেয়েরা পিতামাতাকে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে৷ তাই ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক হবে খুবই মধুর৷

রেডিও, টেলিবিশন, ফিল্ম ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমগুলি শোষণ ও নিহিত স্বার্থবাদীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকবে৷ উচ্চমানের শিক্ষাদান ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে উৎকর্ষ সম্পন্ন পেশাদার লোকেরাই এই প্রচার মাধ্যমগুলি পরিচালনা করবেন৷

বিজ্ঞান শিক্ষা যথার্থভাবে প্রোৎসাহিত হওয়া উচিত৷ বিজ্ঞানচর্চা ও তার প্রয়োগ শিক্ষাবিস্তারে খুব সহায়ক হবে৷ তাছাড়া এর ফলে সামাজিক, আর্থিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সকলের জন্যে বিদ্যা অর্জনের অধিকার সুনিশ্চিত হবে৷ বিদ্যা ও বিজ্ঞান এগুলি হবে মুক্ত আলো বাতাসের মত, এগুলি প্রত্যেককে প্রাণরস জুগিয়ে চলবে৷