হেমন্তের পরে আসে শীত৷ সকালবেলা পাকা ধানের শিষে শিষে ঝলমলিয়ে ওঠে শিশিরবিন্দু৷ ‘সকাল হতে সন্ধ্যে’ সমস্ত ক্ষেত মুখর হয়ে ওঠে ধান কাটার গানে৷ চাষীর গোলায় ধান আর ধরে না, ছড়াছড়ি যায় গৃহের প্রাঙ্গণে৷ শুধু ধান নয়৷ শাকসব্জীর ক্ষেতও ফসলে পরিপূর্ণ৷ পালংশাক , বাঁধাকপি, ফুলকপি, কড়াইশঁুটি, বেগুন, টম্যাটো, নতুন আলু , মূলো, বিট, গাজর--- আরো কত রকম ফসল৷ খুব সস্তা৷ যত পারো খাও৷ তাই বুঝি আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ শীতকালকে এমন সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করেছেন---
নমো, নমো, নমো৷
নমো, নমো, নমো৷
তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য,
অমৃত-অন্ন-ভোগ ধন্য করো
অন্তর মম৷৷
বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ যখন এই গানটি লিখেছিলেন তখনকার পরিস্থিতি আজকের মতো ছিল না৷
শীতের হিমেল হাওয়ায় আমলকীর পাতাগুলো একে একে ঝরে পড়লো৷ তাই দেখে কবির মন উঠলো জেগে৷ একটি অপূর্ব তত্ত্বকে রূপ দিলেন গানে---
শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা৷ শীতের পরশ থেকে থেকে যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে সব খোয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে৷৷
শরতে যে শিউলিগুলো পূর্ণ যৌবন নিয়ে হেসে উঠেছিল তাদের প্রাণের উত্তাপ শীতল হয়ে গেল হেমন্তের হিমেল হাওয়ায়৷ আর শীতের নিদারুণ আগমণে ফুরালো আয়ু৷ যে-শিউলিগুলো ছিল কবির বনের যে শিউলিগুলো ছিল কবির বনের একান্ত সম্বল সে-গুলোকে হারিয়ে কবি এখন একেবারে নিঃস্ব৷ ঠিক এমন সঙ্কট মুহূর্তেই তাঁর প্রিয়তম এসে হাজির৷ তাঁকে দেবার মতো কবির আজ আর কিছুই নেই৷ তাই কেবল অন্তরেই তিনি তাঁর পূজার আয়োজন করতে লাগলেন---
তাই গোপনে সাজিয়ে ডালা
দুখের সুরে বরণমালা
গাঁথি মনে মনে শূণ্যক্ষণে৷৷
বর্ষশেষে এসেছে শীত৷
অর্থাৎ পৌষের প্রায় মাঝামাঝি বা নোতুন মাস জানুয়ারী৷ কবির তাই নির্দেশ---
এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে৷৷
কিন্তু কাজে ফাঁকী দিলে চলবে না৷
করো ত্বরা, করো ত্বরা,
কাজ আছে মাঠ ভরা---
দেখিতে দেখিতে দিন
আঁধার করে৷৷
কবির এ নির্দেশ শুধু বস্তুজগতেই নয়, আধ্যাত্মিক জগতেও৷ মানুষের জীবন সাধনার জন্য৷ আর এই সাধনাও কর্ম৷ এ-কর্মই চরম কর্ম৷ এ-কর্মে যে অবহেলা করে তার জীবন দিনে দিনে তমসাচ্ছন্নই হয়ে ওঠে৷ তাই এই সাধনা মানুষের অবশ্য করণীয়৷
বাইরের কাজই সব নয়৷ জীবনের সমাপ্তিতে পরমকে পেতে হলে ভেতরের কাজও করতে হয়৷ কর্ম ব্যস্ততাময় সারা দিনের শেষে বহিমুর্খী মনকে করতে হবে অন্তর্মুখী৷ সন্ধ্যাবেলার নিরিবিলিতে পাততে হবে আসন৷ প্রস্তুত হতে হবে রাতের অতিথিকে বরণ করবার জন্য৷ কে ওই রাতের অতিথি? এই তো ‘জীবন-দেবতা’৷ দিনের শেষে এঁরই জন্য অপেক্ষা করতে হবে---
বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা---
আসন আপন হাতে পেতে
রাখো আঙিনাতে
যে সাথী আসিবে রাতে
তাহারি তরে৷৷
পৌষে মাঠের কোল পাকা ফসলে ভরে গেছে৷ মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে সোনার রোদ৷ মাঠে মাঠে শোনা যায় ফসল কাটার গান৷ আকাশ পুলকিত৷ কবিরও মনেও উছলে উঠেছে খুশির গান৷ ঘরেতে আজ তিনি কাউকে থাকতে দেবেন না৷ সবাইকে আসতে হবে বাইরে ---
ঘরেতে আজ কে রবে গো,
খোলো দুয়ার খোলো৷
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রহ্মসাধক৷ ব্রহ্ম---যিনি অনন্ত, অরূপ , অসীম, পূর্ণ৷ তিনি তাঁরই সাধনা করতেন৷ তা বলে তিনি জগৎকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাননি৷ ‘সহস্র বন্ধন মাঝে’ তিনি পেতে চেয়েছিলেন ‘মুক্তির স্বাদ’৷---যা নাকি ‘মহানন্দময়৷’ প্রকৃতির বৈচিত্র তাই তাঁর দৃষ্টিতে এমন নিখঁুতভাবে ধরা পড়েছিল৷ প্রকৃতির জগতে কোন ফাঁক নেই, মৃত্যু নেই, আছে কেবল পরিবর্তন৷ শীতের পরে আসে বসন্ত ৷ কিন্তু বসন্ত এলে শীত যায় কোথায়? বসন্তের আগমণেই কি শীতের মৃত্যুর না৷ সেটা নিছক প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন৷ বসন্ত--- সে তো শীতেরই আরেক রূপ৷ বসন্তের মাঝেই শীত গোপন হয়ে থাকে৷ প্রাণীজগতে যেমনি আত্মার দেহ পরিবর্তন, প্রকৃতির৷ ফাল্গুন সে তো মাঘেরই ভিন্ন রূপ---
পুরানো শীত পাতাঝরা,
তারে এমন নূতন করা!
মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে
খেয়ে ফুলের মার গো৷৷
দক্ষিণের হাওয়া যেন বসন্তের দূত৷ কারণ, যে বসন্তে আমাদের প্রাণে জাগে খুশির হিল্লোল, হৃদয়ে জ্বলে বিরহের আগুন, মন ছুটে যায় রঙের খেলায় মাততে, দক্ষিণের হাওয়া যেন সেই ঋতুরাণী বসন্তেরই শুভ আগমণ বার্র্ত নিয়ে আসে৷ কিন্তু সে বসন্ত কে---যার মধ্যে আমরা পাই মনের হাজার খোরাক? কবির মতে সে বসন্ত কোন স্বতন্ত্র বা মৌলিক ঋতু নয়৷ শীতই বসন্ত৷ আবার বসন্তই শীত৷ শীত সম্পদেই বসন্তই শীত৷ শীতের সম্পদেই বসন্ত সম্পদ্শালী৷
একই পোশাক প্রকৃতি দেবী যেন দু’মাস অন্তর অন্তর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়েন৷ বসন্ত এলে শীত চলে যায় না৷ শীতেরই আরেক রূপ বসন্ত৷ অনুরূপভাবে বসন্তেরই আর এক রূপ শীত৷ দক্ষিণের হাওয়া শীতেরই সম্পদ্ লুট করে বলে,‘আমি বসন্ত৷’ এটা নিছক কবির কল্পনা নয়৷ এ একটি চমৎকার ভৌগোলিক ব্যাখ্যা---
আমরা নূতন প্রাণের চর হা হা৷
আমরা থাকি পথে ঘাটে
নাই আমাদের ঘর হা হা৷৷
নিয়ে পক্ক পাতার পঁুজি
পালাবে শীত, ভাবছ বুঝি গো?
ওসব কেড়ে নেবো, উড়িয়ে দেবো
দখিন হাওয়ার পর হা হা৷৷
তোমায় বাঁধব নূতন ফুলের মালায়
বসন্তের এই বন্দীশালায় ৷
জীর্ণ জরার ছদ্মরূপে
এড়িয়ে যাবে চুপে চুপে ?
তোমার সকল ভূষণ ঢাকা আছে
নাই যে অগোচর হা হা৷৷
তা হলেই বোঝা যাচ্ছে শীতকে যে আমরা জীর্ণজরার প্রতীক ভাবি সেটা মস্ত ভুল৷ কারণ জীর্ণজরা শীতের আসল রূপ নয়, ছদ্মরূপ৷ তাই মাঘ শেষ হয়ে যেতেই কবি শীতকে বলছেন বসন্ত হতে৷ পুরোনো বেশ ছেড়ে ধারণ করতে বলছেন নোতুন বেশ৷
পলাশরেণুর রঙ মাখিয়ে
নবীন বসন এনেছি এ,
সবাই মিলে দিই ঘুচিয়ে
পুরানো আচ্ছাদন, তোমার
পুরানো আচ্ছাদন৷৷
উপসংহারে বলা চলে শীত ঋতুটা কবির কাছে খুব একটা উপভোগ্য ছিল না৷ শীতকে তিনি যেন বসন্তেরই আভাস ভেবে খুশী হতে চেয়েছেন৷ তাই কতক্ষণ বাদে বাদেই তিনি বসন্তের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন৷ পরিশেষে, আর একটি বিষয় সবিশেষ লক্ষণীয় যে, কবির মন যখনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দর্শনে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে তখনই তিনি তাঁর শীত বিষয়ক সংগীতে একটু বিরক্তিই প্রকাশ করেছেন৷ এবং শীতকে তিনি বিরাট অপকর্মের দায়ে দায়ী করেছেন---
শীতের বনে কোন্ সে কঠিন
আসবে বলে
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন
বনের কোলে ৷৷
আমলকী ডাল সাজাল কাঙাল,
খসিয়ে দিস পল্লবজাল,
কাশের হাসি হাওয়া ভাসি
যায় যে চলে৷৷
- Log in to post comments