শীতকাল ও রবীন্দ্রসংগীত

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

হেমন্তের পরে আসে শীত৷ সকালবেলা পাকা ধানের শিষে শিষে  ঝলমলিয়ে ওঠে শিশিরবিন্দু৷ ‘সকাল হতে সন্ধ্যে’ সমস্ত ক্ষেত মুখর হয়ে ওঠে ধান কাটার গানে৷ চাষীর গোলায় ধান আর ধরে না, ছড়াছড়ি  যায় গৃহের  প্রাঙ্গণে৷ শুধু ধান নয়৷ শাকসব্জীর ক্ষেতও ফসলে পরিপূর্ণ৷ পালংশাক , বাঁধাকপি, ফুলকপি, কড়াইশঁুটি, বেগুন, টম্যাটো, নতুন আলু , মূলো, বিট, গাজর--- আরো কত রকম ফসল৷ খুব সস্তা৷  যত পারো খাও৷ তাই বুঝি  আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ  শীতকালকে এমন সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করেছেন---

নমো, নমো, নমো৷

নমো, নমো, নমো৷

তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য,

অমৃত-অন্ন-ভোগ ধন্য করো

অন্তর মম৷৷

বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ যখন এই গানটি লিখেছিলেন তখনকার পরিস্থিতি আজকের মতো ছিল না৷

শীতের হিমেল হাওয়ায় আমলকীর পাতাগুলো একে একে  ঝরে পড়লো৷ তাই দেখে  কবির মন উঠলো জেগে৷ একটি  অপূর্ব তত্ত্বকে রূপ দিলেন  গানে---

শূন্য করে  ভরে দেওয়া যাহার খেলা  তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা৷ শীতের পরশ থেকে থেকে  যায়  বুঝি ওই ডেকে ডেকে  সব খোয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে৷৷

শরতে  যে  শিউলিগুলো পূর্ণ যৌবন নিয়ে হেসে উঠেছিল তাদের প্রাণের উত্তাপ শীতল হয়ে গেল হেমন্তের হিমেল  হাওয়ায়৷  আর শীতের নিদারুণ আগমণে ফুরালো  আয়ু৷ যে-শিউলিগুলো ছিল কবির বনের যে শিউলিগুলো ছিল কবির বনের একান্ত  সম্বল সে-গুলোকে হারিয়ে কবি এখন একেবারে নিঃস্ব৷ ঠিক এমন সঙ্কট  মুহূর্তেই তাঁর প্রিয়তম এসে হাজির৷ তাঁকে দেবার মতো কবির আজ আর  কিছুই নেই৷ তাই কেবল অন্তরেই তিনি তাঁর পূজার  আয়োজন করতে লাগলেন---

তাই গোপনে সাজিয়ে ডালা

দুখের সুরে  বরণমালা

গাঁথি মনে মনে শূণ্যক্ষণে৷৷

বর্ষশেষে এসেছে শীত৷

অর্থাৎ পৌষের প্রায় মাঝামাঝি  বা নোতুন মাস  জানুয়ারী৷  কবির তাই নির্দেশ---

এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে৷৷

কিন্তু কাজে ফাঁকী দিলে চলবে না৷

করো ত্বরা, করো ত্বরা,

কাজ আছে মাঠ ভরা---

দেখিতে দেখিতে দিন

আঁধার করে৷৷

কবির এ নির্দেশ শুধু বস্তুজগতেই নয়, আধ্যাত্মিক জগতেও৷ মানুষের জীবন সাধনার জন্য৷ আর এই সাধনাও কর্ম৷ এ-কর্মই চরম কর্ম৷ এ-কর্মে যে অবহেলা করে তার জীবন দিনে দিনে তমসাচ্ছন্নই হয়ে ওঠে৷ তাই এই সাধনা মানুষের অবশ্য করণীয়৷

বাইরের কাজই সব নয়৷ জীবনের সমাপ্তিতে পরমকে  পেতে হলে ভেতরের কাজও করতে হয়৷ কর্ম ব্যস্ততাময় সারা দিনের শেষে বহিমুর্খী মনকে  করতে হবে অন্তর্মুখী৷ সন্ধ্যাবেলার নিরিবিলিতে পাততে হবে আসন৷ প্রস্তুত হতে হবে রাতের অতিথিকে বরণ করবার  জন্য৷ কে ওই রাতের অতিথি? এই তো ‘জীবন-দেবতা’৷ দিনের শেষে এঁরই জন্য অপেক্ষা করতে হবে---

বাহিরে কাজের পালা হইবে সারা আকাশে উঠিবে যবে সন্ধ্যাতারা---

আসন আপন হাতে পেতে

রাখো আঙিনাতে

যে সাথী আসিবে রাতে

তাহারি তরে৷৷

পৌষে মাঠের কোল পাকা ফসলে ভরে গেছে৷ মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে সোনার রোদ৷ মাঠে মাঠে শোনা যায় ফসল কাটার গান৷ আকাশ পুলকিত৷ কবিরও মনেও উছলে উঠেছে খুশির গান৷ ঘরেতে আজ তিনি কাউকে থাকতে দেবেন না৷ সবাইকে আসতে হবে বাইরে ---

ঘরেতে আজ কে রবে গো,

খোলো দুয়ার খোলো৷

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রহ্মসাধক৷ ব্রহ্ম---যিনি অনন্ত, অরূপ , অসীম, পূর্ণ৷ তিনি তাঁরই সাধনা করতেন৷ তা বলে তিনি জগৎকে  মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাননি৷  ‘সহস্র বন্ধন মাঝে’ তিনি পেতে চেয়েছিলেন ‘মুক্তির স্বাদ’৷---যা নাকি ‘মহানন্দময়৷’ প্রকৃতির বৈচিত্র তাই  তাঁর দৃষ্টিতে এমন নিখঁুতভাবে ধরা পড়েছিল৷  প্রকৃতির জগতে কোন ফাঁক নেই, মৃত্যু নেই, আছে কেবল পরিবর্তন৷ শীতের  পরে আসে বসন্ত ৷ কিন্তু বসন্ত এলে শীত যায় কোথায়? বসন্তের আগমণেই কি শীতের মৃত্যুর না৷ সেটা নিছক প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন৷ বসন্ত--- সে তো শীতেরই আরেক রূপ৷ বসন্তের  মাঝেই শীত গোপন  হয়ে থাকে৷ প্রাণীজগতে যেমনি  আত্মার  দেহ পরিবর্তন, প্রকৃতির৷ ফাল্গুন সে তো মাঘেরই ভিন্ন রূপ---

পুরানো শীত পাতাঝরা,

তারে এমন নূতন করা!

মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে

খেয়ে ফুলের মার গো৷৷

দক্ষিণের হাওয়া যেন বসন্তের দূত৷ কারণ, যে বসন্তে আমাদের প্রাণে জাগে খুশির হিল্লোল, হৃদয়ে জ্বলে বিরহের আগুন, মন ছুটে যায় রঙের খেলায় মাততে, দক্ষিণের  হাওয়া যেন সেই ঋতুরাণী বসন্তেরই শুভ আগমণ বার্র্ত নিয়ে আসে৷ কিন্তু সে বসন্ত কে---যার মধ্যে আমরা পাই মনের হাজার খোরাক? কবির মতে সে বসন্ত  কোন স্বতন্ত্র বা মৌলিক ঋতু নয়৷ শীতই বসন্ত৷ আবার বসন্তই শীত৷ শীত সম্পদেই বসন্তই শীত৷ শীতের সম্পদেই বসন্ত সম্পদ্শালী৷

একই পোশাক প্রকৃতি দেবী যেন দু’মাস অন্তর অন্তর  ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়েন৷ বসন্ত এলে শীত চলে যায় না৷  শীতেরই আরেক রূপ বসন্ত৷ অনুরূপভাবে বসন্তেরই আর এক রূপ শীত৷ দক্ষিণের হাওয়া শীতেরই   সম্পদ্ লুট করে বলে,‘আমি বসন্ত৷’  এটা নিছক কবির কল্পনা নয়৷ এ একটি চমৎকার  ভৌগোলিক ব্যাখ্যা---

আমরা নূতন প্রাণের  চর হা হা৷

আমরা থাকি পথে  ঘাটে

নাই আমাদের ঘর হা হা৷৷

নিয়ে পক্ক পাতার পঁুজি

পালাবে শীত, ভাবছ বুঝি গো?

 

ওসব কেড়ে নেবো, উড়িয়ে দেবো

দখিন হাওয়ার পর হা হা৷৷

তোমায় বাঁধব নূতন ফুলের মালায়

বসন্তের  এই বন্দীশালায় ৷

জীর্ণ জরার  ছদ্মরূপে

এড়িয়ে  যাবে  চুপে চুপে ?

তোমার সকল ভূষণ ঢাকা  আছে

নাই যে অগোচর হা হা৷৷

 

তা হলেই বোঝা যাচ্ছে শীতকে যে আমরা জীর্ণজরার প্রতীক ভাবি  সেটা মস্ত ভুল৷ কারণ জীর্ণজরা শীতের আসল রূপ নয়, ছদ্মরূপ৷ তাই  মাঘ শেষ হয়ে যেতেই কবি শীতকে বলছেন বসন্ত হতে৷ পুরোনো বেশ ছেড়ে  ধারণ করতে বলছেন নোতুন বেশ৷

পলাশরেণুর  রঙ মাখিয়ে

নবীন বসন এনেছি এ,

সবাই মিলে দিই ঘুচিয়ে

পুরানো আচ্ছাদন, তোমার

পুরানো আচ্ছাদন৷৷

উপসংহারে বলা চলে শীত ঋতুটা কবির কাছে  খুব একটা উপভোগ্য ছিল না৷  শীতকে তিনি যেন বসন্তেরই আভাস ভেবে খুশী হতে চেয়েছেন৷ তাই কতক্ষণ বাদে  বাদেই তিনি বসন্তের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন৷ পরিশেষে, আর একটি  বিষয় সবিশেষ লক্ষণীয় যে, কবির মন যখনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দর্শনে উদ্গ্রীব হয়ে  উঠেছে  তখনই তিনি তাঁর শীত বিষয়ক সংগীতে একটু বিরক্তিই প্রকাশ করেছেন৷ এবং শীতকে তিনি বিরাট  অপকর্মের দায়ে দায়ী করেছেন---

শীতের বনে কোন্ সে কঠিন

আসবে বলে

শিউলিগুলি ভয়ে মলিন

বনের কোলে ৷৷

আমলকী ডাল  সাজাল কাঙাল,

 খসিয়ে দিস পল্লবজাল,

কাশের  হাসি হাওয়া ভাসি

যায় যে চলে৷৷