সমবায়ের সাফল্যের তিনতত্ত্ব

লেখক
পত্রিকা প্রতিনিধি

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শেষ পরিণতি ফ্যাসিস্ট শোষণ৷ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষের অর্থনীতি ও রাজনীতি পুঁজিবাদী শোষকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷ আজ ভারত তথা বাঙলায় সেই পুঁজিবাদী শোষকরা ফ্যাসিস্ট রূপ ধারণ করেছে৷ ফ্যাসিস্ট শোষণে বিপর্যস্ত বাঙলার অর্থনীতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি, শিল্প সাহিত্য সংসৃকতি-জীবনের সর্বক্ষেত্র৷ আবার মাকর্সবাদী রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ব্যষ্টি স্বাধীনতা অবদমিত৷ তাই কৃষি ও শিল্পে কমিউন ব্যবস্থায় শ্রমিক-কর্ষকদের কোন অনুপ্রেরণা থাকে না৷ রাষ্ট্রের ইচ্ছাধিনে তাকে কাজ করতে হয়৷ তাই উভয়ক্ষেত্রে উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়৷ ফলে আর্থিক ব্যবস্থার মোদ্দা কথা যে উন্নয়ন তা চরমভাবে ব্যাহত হয়৷ তাই ব্যাষ্টিপুঁজিবাদ ও মার্কসবাদী রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ দুটোর কোনটাই সামগ্রিক আর্থিক উন্নয়ণ তথা জনকল্যাণমূলক বলা চলে না৷

প্রাউটের দৃষ্টিতে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামগ্রিক ভাবে সামাজিক অর্থনৈতিক  উন্নয়নের মৌলিক ভিত্তি হলো সমবায় ব্যবস্থা৷ সামবায়িক ব্যবস্থায় কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে যুক্ত প্রতিটি কর্ষক শ্রমিক মালিকানার অংশীদার৷ তাই এখানে শ্রমিক মালিক সংঘাতের প্রশ্ণ উঠে না৷ সামবায়িক ব্যবস্থায় পরিচালক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কটা প্রভু-ভৃত্যের হয় না, সম্পর্কটা থাকে বন্ধুত্বপূর্ণ৷ পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতায় গড়ে ওঠে সমবায়৷ তাই সমবায়ে শোষণের কোন সুযোগ থাকে না৷

কিন্তু ভারতবর্ষে আর্থিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সরকারী উদ্যোগে সামগ্রিক আর্থিক বিকাশের লক্ষ্যে কোন সামবায়িক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি৷ ব্যষ্টি বা সমষ্টিগতভাবে বে-সরকারী উদ্যোগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারী সহযোগিতায় গড়ে উঠলেও সেভাবে সফল হয়নি৷ ফলে সমবায় সম্পর্কে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করে৷ তাই  জনসাধারণের কাছে সমবায় সেভাবে গ্রহণ যোগ্য হয়ে ওঠেনি৷ অবশ্য এর জন্যে সমবায়কে দোষারোপ করা চলে না৷ পরিচালন ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো গত ত্রুটিই সমবায়ের  সফল না হওয়ার মূল কারণ৷

প্রাউট প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার  সমবায়কে সফল করতে তিনটি তত্ত্বের উপর জোর দিয়েছেন৷ প্রথমত সমবায়ের পরিচালক ও সকল সদস্যকে দৃঢ় নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ দ্বিতীয় সমবায় পরিচালনা কড়া তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে, তৃতীয় সমবায়কে যাতে জনগণ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে৷ এই তিন তত্ত্বের সফল প্রয়োগের উপর সমবায়ের সফলতা নির্ভর করে৷ পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত ইজরায়েল সমবায়কে সফলভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে৷ চতুর্দিকে শত্রু পরিবেষ্টিত ইজরায়েলে জনগণের মধ্যে একটা জাতীয়তাবোধ স্ব-নির্ভরতা চেতনা গড়ে উঠেছে ও জনগণের নৈতিক মান উন্নত হওয়ায় প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঁচার তাগিদে সমবায়ের সাহায্যে শুষ্ক মরুভূমিকে সুজলা সুফলা করে গড়ে তুলেছে৷

স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্ণ থেকেই বা বলা যায় তারও আগে থেকে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় শাসক-বিরোধী সব পক্ষই পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতে বাধ্য৷ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতিতে সমাজের সর্বক্ষেত্রে পরিচালকদের নৈতিকমান তলানিতে৷ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে  সমবায় গড়ে উঠলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পরিচালকবর্গের  নৈতিক দুর্বলতার কারণে ভারতে সমবায় ব্যর্থতার নজির সৃষ্টি করেছে৷ ফলে জনগণ সমবায়ের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছে৷

তবে সময় এখনও আছে৷ প্রাউট প্রদর্শিত পথে উল্লিখিত তিনটি তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করতে পারলে ভারতে সমবায় সফল হতে বাধ্য ও একটি সুদৃঢ় মজবুত আর্থিক পরিকাঠামো গড়ে উঠবে৷ প্রাউটের দৃষ্টিতে সমবায় প্রথার অর্ন্তনিহিত ভাবটি হ’ল বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা৷ অর্থাৎ সমবায় ব্যবস্থায় পরিচালক ও শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্কটা প্রভু-ভৃত্যের নয়, বন্ধুত্বের ও সকলে সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে কাজ করবে৷ কেবল এই মানসিক ভাব ও উল্লিখিত তিনটি তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করতে পারলে সামাজিক-আর্থিক ক্ষেত্রে  সুষ্ঠু ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রগতি ঘটানো সম্ভব হবে৷ প্রাউটের সামাজিক  অর্থনৈতিকতত্ত্বে সমবায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই আদর্শপন্থা মানবসমাজে চিরস্থায়ী ঐক্য স্থাপনের৷ তাই পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক বিকাশের জন্যে তিনটি তত্ত্বের সফল প্রয়োগের দ্বারা ব্যাপকভাবে  সমবায় প্রথা গড়ে তোলার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের৷