সমস্যার গভীরে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

এরাজ্যের হাজার হাজার মানুষ অন্য রাজ্যে কর্মসংস্থানের জন্যে পাড়ি দিয়েছে৷ সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার কুলঙ্গায়ের পাঁচজন কশ্মীরে আপেল বাগানে কাজ করতে গিয়ে জঙ্গীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে৷ এ সংবাদ আমাদের মর্মাহত করেছে৷ এর আগেও মহারাষ্ট্রে, কর্ণাটকে, রাজস্থানে, পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক নির্যাতিত হয়েছে, ওই সমস্ত রাজ্যের স্থানীয় মানুষের রোষের শিকার হতে হয়েছে৷ ফলে কোন কোন সময় আতঙ্কিত হয়ে বাঙালী শ্রমিকরা স্বরাজ্যে পাড়ি দিয়েছে৷ কিন্তু যেহেতু স্বস্থানে কর্মসংস্থানের উপায় নেই, তাই বাধ্য হয়ে কাজের জন্যে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া বন্ধ হয়নি৷ বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি প্রায়ই গ্রামাঞ্চল থেকে বেকার যুবকরা অন্য রাজ্যে কাজের জন্যে পাড়ি দিয়েছে৷

আজকের অর্থনীতির এই প্রবণতা অশনি সংকেত রূপে দেখা দিয়েছে৷ যে কোন রাজ্যে, যে কোন সময় ওখানকার স্থানীয় বেকাররা বহিরাগতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে৷

তাই এটা মোটেই সুস্থ অর্থনীতির প্রমাণ নয়৷ প্রাউটের নীতি হ’ল আপন আপন এলাকায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চল গড়ে তোলা উচিত৷ যেমন বাঙলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চলরূপে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে৷ অর্থাৎ এই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে অর্থ ও কাঁচামালের বহিঃস্রোত বন্ধ করতে হবে৷ এই এলাকাতেই প্রতিটি জেলার প্রতিটি ব্লকে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন করতে হবে, যাতে এখানকার প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়৷ এই পরিকল্পনা নিয়েই ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে৷ প্রাউটের সুসন্তুলিত অর্থনীতির আদর্শ মেনে কৃষিতে ৩০-৪০%, কৃষি ভিত্তিক শিল্পে ২%, কৃষি সহায়ক শিল্পৈ ২% অকৃষি শিল্পে ২% ---গড়ে তোলার কর্মজগৎ শুরু করতে হবে৷ এ ব্যাপারে যৌথ মালিকানা বা সমবায় নীতিকেই আদর্শ হিসেকে গ্রহণ করতে হবে৷ বাইরের থেকে বড় বড় পুঁজিপতিদের ডেকে এনে এখানে-ওখানে দু’চারটি বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলে বা ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় বড় দেশী ও বিদেশী পুঁজিপতিদের বড় আকারে  পুঁজি বিনিয়োগ করিয়ে সমস্যার আদৌ সমাধান হবে না৷ পরন্তু দেশের অর্থশক্তি দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা যাবে না৷ বিপুল অর্থশক্তি কুক্ষিগত করে এরা অর্থবলে দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করে৷ ফলে সৎ নেতা-নেত্রীর বদলে অসৎ নেতা-নেত্রীরা পুঁজিপতিদের অর্থের সাহায্যে শাসন ক্ষমতায় আসে৷ যে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নীতি দেশের সর্বসাধারণের কল্যানের অনুকূল, তাদের সহজে পরাজিত করে পুঁজিপতিদের সমর্থক দল৷ প্রচলিত গণতন্ত্রে টাকার খেলায় এটা হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়৷

এইভাবে গণতন্ত্রের আড়ালে দেশে বা সমাজে পুঁজিবাদীতন্ত্র বা বৈশ্যতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে আছে৷ আর এই মুনাফাবাজরা দেশের শিক্ষা--সংসৃকতি ও তথাকথিত ধর্মীয় সংস্থাগুলিকে পণ্যে পরিণত করে---এইগুলির চরম অবনয়ন ঘটায়৷ এমনিভাবে বাইরের ঝাঁ-চকচক রাস্তাঘাট, অত্যাধুনিক যানবাহন, বিশাল বিশাল বহুতল বাড়ীর তলায় নীতি-ধর্ম-মানবতা-সভ্যতা, মূল্যবোধ এ সবই মাথাকূটে মরতে থাকে৷ রাজতন্ত্রে রাজা ও তার পেয়াদাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে মানুষ একদিন অনেক রক্ত ঝরিয়ে গণতন্ত্রের সূচনা করেছিল৷ কিন্তু সেই গণতন্ত্র যে লোকচক্ষুর সামনেই বৈশ্যতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে রাজতন্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে৷ এই সত্যকে আজ গভীরভাবে উপলব্ধি করার সময় এসেছে৷

শুরু করেছিলাম রাজ্য থেকে শ্রমিকের বহিঃস্রোতের সমস্যা নিয়ে৷ এই সমস্যা থেকে শুরু করে আজ যে পুঁজিবাদী তথা বৈশ্যতন্ত্রে শোষণের প্রসঙ্গে পৌঁছে গেলুম, তার কারণ আজকের এই যে কর্মসংস্থানের সন্ধানে রাজ্যের শ্রমিকদের রাজ্য ত্যাগ ও কর্মের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো---এর পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীরই বিছানো সূক্ষ্ম জাল৷  তারা চায়না দেশের বিভিন্ন রাজ্য বা এলাকা (অর্থনৈতিক অঞ্চল) অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করুক৷ তাহলে তো ওইসব এলাকা থেকে কাঁচামালের বহিঃস্রোত ঘটানো বা অর্থের বহিঃস্রোত ঘটানো চলবে না৷ তাহলে যে ওদের শোষণের কল বন্ধ হয়ে যাবে৷

মনে নেই? ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরা বাংলার বিশ্ববিখ্যাত তাঁতশিল্পকে ধবংস করতে এখানকার তাঁতীদের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল৷ এইভাবে এখানকার তাঁতশিল্পকে ধবংস করে এখান থেকে তুলো ম্যাঞ্চেস্টারে নিয়ে গিয়ে সেখানে মিলের কাপড় উৎপাদন করে এই বাঙলায় বিক্রি করত অনেক বেশী দামে৷ সেই পুঁজিবাদী বা বৈশ্য শোষণ সমাজে চলছে, কেবল রং বদল হচ্ছে৷ তাই আমাদের শুধু সমস্যার ওপরে ওপরে ঘুরে না বেড়িয়ে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে৷ তারপর সেই সমস্যাব স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবতে হবে৷