জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বাত্মক জয়লাভের ইচ্ছা মানুষের মধ্যে আদিম ও অনন্ত৷ প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয়---জীবনের সকল ক্ষেত্রে ছোট হয়ে বাঁচাটা মানুষের পক্ষে অভাবনীয়৷ অনন্তকাল ধরে প্রকৃতির আজ্ঞাবহ ভৃত্য হিসেবে বাঁধাধরা পথে চলার ধারণা কোনদিনই তার মনঃপুত নয়৷ তবে সে যে অনেক সময় প্রকৃতির নিয়মমাফিক চলে জানতে হবে, সেটা, নিতান্তই অবস্থার চাপে পড়ে৷ আর সেটা হচ্ছে তার পর্যাপ্ত পরিমাণ বুদ্ধি বা Intellect ও Stamina-র অভাব৷ তার সর্ব সাধনা হচ্ছে কেবল এইসমস্ত অভ্যন্তরীণ দুলতাগুলোকে দূর করার প্রচেষ্টার নামান্তর মাত্র৷ মনোজগতের অপূর্ণতা দূর করার জন্যে তাই সে অহরহই আদর্শগত সংঘর্ষকে অভ্যর্থনা জানায় ও জন্ম দেয় নোতুন নোতুন জীবনদর্শনের৷ এইভাবেই মানবসমাজে সৃষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চরম আত্মবিকাশের এক মহান যুক্তিসঙ্গত আদর্শ৷
আবার মানসিক অপূর্ণতা দূর করার জন্যেই কিন্তু তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় না৷ যেহেতু তাকে টিঁকে থাকতে হয় আপাতঃ-প্রতিকূল স্থূল জগতে, তাই স্বাভাবিকভাবেই দৈহিক ক্ষেত্রেও তাকে সাধনা করে যেতে হচ্ছে৷ তমোগুণী প্রকৃতিকে জয় করতে গিয়েই উদ্ভব হয়েছে Science বা ভৌতিক বিজ্ঞানের৷ সংসৃকত শব্দ ‘বিজ্ঞান’ আর ইংরেজী শব্দ Science কিন্তু একার্থবোধক নয়৷ কারণ সংসৃকতে বিজ্ঞান লতে ব্রহ্মবিজ্ঞান বা অধ্যাত্মবিজ্ঞানকেই বোঝায়৷
আজ একদল লোক অভিযোগ তুলছে---বিজ্ঞান নাকি সব অনর্থের মূল৷ নিত্য-নোতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানব সমাজে নিত্যই-বিসংবাদ সৃষ্টি করছে৷ এইভাবে তা’ সমস্ত মানব সভ্যতাকে ধবংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে৷ তাই আজ এঁদের মতটাকে খোলা মন নিয়ে যথেষ্ট অধ্যবসায় ও সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখে নেওয়া দরকার৷
স্থূল ভৌতিক জগতের সংগ্রামে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখলে মানুষ তৎক্ষণাৎ সংগ্রামের উদ্দেশ্যে নোতুন অস্ত্রশস্ত্রের প্রস্তুতির আয়োজন শুরু করে দেয়৷ আর ভৌতিক বিজ্ঞানের কাজ হ’ল---নিতি নিতি ফরমূলা বের করে প্রস্তুতির কাজে সহায়তা করা৷ যদি কোনদিন দৈহিক সংঘর্ষ না চলত, তাহলে মানবমনের সৃষ্টি বা বিবর্তন কোনদিনই সম্ভব হ’ত না৷ আজকের সূক্ষ্ম মানব-মনীষার আবির্ভাব সম্পূর্ণ অজ্ঞাতই থেকে যেতো৷ এটা সকল জীবের মধ্যেই হয়ে চলেছে ও তা থেকে সকল জীবই নিজ নিজ মানসিক প্রবণতা ও শক্তি অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার অনুবর্তন করে চলেছে৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ, বাদুড়দের বাসা নির্মাণ, উইএর চলা-পথ তৈরী, মাকড়সার জাল বোনা---এ সই জীবের বৈজ্ঞানিক দ্ধির পরিচয় দেয়৷
আজ তোমরা এতগুলো লোক যে এই ক্ষণটিতে গোরক্ষপুরে জড়ো হয়েছ, এখন জিজ্ঞাসা করি---যদি আজ কোন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি না হ’ত তাহলে সুদূর প্রত্যন্ত প্রদেশ থেকে সকলের পক্ষে হেঁটে আসা সম্ভব হ’ত কি? দৈহিক তথা মানসিক অসুবিধাগুলো দূর করার জন্যেই কোন এক বিশেষ যুগের মানুষ গো-গাড়ীর উদ্ভাবন ও প্রচলন করেছিলেন৷ কিছুদিন পর আবার অধিকতর দ্রুতগামী অশ্বযানের প্রচলন শুরু হ’ল৷ পরবর্তীকালে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদারও পরিবর্তন হতে লাগল৷ তাই বিভিন্ন যুগে বিভিন্নতর যানবাহন---মোটর-গাড়ী, এরোপ্লেন ও সাম্প্রতিক কালে রকেট আবিষৃকত হয়েছে৷ এগুলোর কোনটাই নিন্দনীয় নয়, এগুলো শুধুমাত্র যুগের সন্ধিক্ষণে পরিবর্তিত মানসিক চাহিদা পূরণ করার বিভিন্ন মাধ্যম মাত্র৷
আমরা জানি, গুড়কে প্রাকৃতিক প্রভাববশতঃ স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘদিন রাখা যায় না৷ অধিকন্তু গুড়ের স্বাদ অনেকের পছন্দও নয়৷ এই দুই কারণে মানুষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গুড় থেকে চীনী তৈরী করেছে৷ এর থেকে কি কেউ বলর্েন যে চীনীর আবিষ্কার মানব-প্রগতির অন্তরায়? এক্ষেত্রে যদি কেউ গুড়কে চীনী অপেক্ষা অধিকতর পুষ্টিকর মনে করেন, সেক্ষেত্রে চীনীর সঙ্গে ওই সমস্ত পুষ্টিবর্ধক উপাদানগুলো সংযুক্ত করাটাই কি অধিকতর বিজ্ঞান-বুদ্ধিসম্মত হবে না? তা, সেক্ষেত্রে গুড়ের পক্ষে প্রপাগাণ্ডা চালানোটা যুক্তিসঙ্গত হবে?
কিছু লোক সব সময়ে সম্ভাব্য সকল প্রকারেই বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নিষ্ফল সমালোচনা করতে দেখা যায়৷ অবশ্য এই ধরণের সমালোচনা তাদের কাছ থেকেই আসে যারা জীবনীশক্তি ও সামর্থ্য হারিয়ে নোতুনের সঙ্গে রফা করতে অক্ষম হয় ও যারা দৈহিক অক্ষমতা-র্নিন্ধন ওটাকে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসের্েই মেনে নিয়েছে৷
অতীতের সংবেগ মানুষকে অতি সহজে নোতুন পরিবেশের সঙ্গে পাপ খাইয়ে নিতে বাধা দেয়৷ এইজন্যে কিছু মানুষ জেনে-ঝেও বৈজ্ঞানিক অবদানকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করে৷ যতদিন না নোতুন নোতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়ার সঙ্গে তাদের মাত্রনসিক সমান্তরালতা সংরক্ষিত হচ্ছে, ততদিন তারা সেই সমস্ত বস্তুর বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করে, যা থেকে তারা অনেক সময় বাধ্য হয়ে সুবিধাজনক সেবা আদায় করে থাকে৷ এইজন্যে দেখা যায়, যারা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কঠোর সমালোচক ও অপর দিকে আদিম চিকিৎসা-শাস্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারাও সর্বাধুনিক ‘‘এ্যালোপ্যাথি’’-সম্মত বাণ্ডেজ ব্যবহারে কোনই আপত্তি তোলেন না৷ এমন কি খাদি বস্ত্রের একনিষ্ঠ ভক্তবৃন্দ, গুড়-দর্শনের প্রচারকগণ ও গো-যানের সমর্থকেরাও মিল-জাত বস্ত্র পরিধান করে, চীনী-মেশানো চা পান করে বা এরোপ্লেনে চড়ে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে সভায় গরম গরম বত্তৃণতা দিতে যায়৷ (ক্রমশঃ)