পূর্ব প্রকাশিতের পর,
সমস্যার পরিবর্তনের জন্যে মানুষের মনও নোতুন নোতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়ায় নিযুক্ত হয়ে রয়েছে৷ এ থেকেই আমি ৰলতে ৰাধ্য হচ্ছি যে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হৰে ও তা’ কোনদিনই মানবপ্রগতির পরিপন্থী হয়ে উঠবে না৷ কিন্তু বিজ্ঞানের সমালোচকদের অধিকাংশই কেবল ভাবাবেগের মাথায় এই সহজ সত্যটা স্বীকার করতে চায় না তারা জানে না যে তারা তাদের অতীতের প্রতি অন্ধপ্রীতি দিয়ে তাদের মানসসত্তার গতিধারাকে স্থূলত্বের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে! এ দিয়ে তারা মনকে অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলছে ও গতিশীলতা হারিয়ে ফেলছে৷ আর যারা জীবনে চলার ছন্দকে হারিয়ে ফেলেছে, তাদি’কে তমসাচ্ছন্ন, স্থূল জড় ৰলাই অধিকতর সমীচীন হৰে৷
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনকে সর্বদাই বিভিন্ন প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপৃত থাকতেই হৰে৷ এই সমস্ত নোতুন দায়িত্ব সম্পাদনে সক্ষম হবার জন্যে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে চলেছে৷ এর সঙ্গে দৈহিক গ্রন্থিগুলোর কাঠামোও পরির্তিত হচ্ছে৷ এতে করে’ শুধু যে মানুষের দেহ ও মনের সংরচনা জটিলতর হচ্ছে তা নয়, মানুষের সমগ্র সমাজেও সেই জটিলতা এসে পড়েছে৷ বিভিন্ন সমস্যাও উত্তরোত্তর ৰেড়েই চলেছে৷ এই অবস্থায় আমরা কি শুধু অতীত গরিমার মহিমা কীর্তন করেই আত্মতৃপ্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকবো? না---তা না করে আমাদের উচিত, যথাযথ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের দ্বারা ওই সৰ সমস্যার যথার্থ সমাধান বের করা? কথায় ৰলে, যেমন তরবারি তেমনই তার আধার৷ এজন্যে যত জটিল সমস্যা আছে, ততই জটিল বৈজ্ঞানিক উপকরণের উদ্ভাবন করতে হৰে৷ আমরা আদিম তীর ধনুক দিয়ে আধুনিক যুগের মহাশক্তিশালী আণবিক বোমার সম্মুখীন হয়ে নিশ্চয়ই হাস্যাস্পদ হতে চাই না৷
মানবদেহের অভ্যন্তরে জটিলতা যতই ৰাড়ছে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণও ততই ৰেড়ে যাচ্ছে৷ বৈজ্ঞানিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এমনও ঘটতে পারে যে এই সন্দেহটাকে গোরক্ষপুরের কোন এক জায়গায় রেখে দিয়ে কেবল মস্তিষ্কটাকে লণ্ডনে পাঠানো যাবে৷ সেক্ষেত্রে দেহের ভারটাকে লণ্ডনে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন থাকবে না৷ এটা রূপকথার মত শুণতে লাগলেও নিশ্চিতই একইরকম ঘটতে চলেছে, যখন লোকে তাদের অঙ্গগুলো ৰ্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে নিরাপদে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে পারৰে৷
বর্ণচক্র বা শ্রেণীচক্র ক্রমাগত বিবর্তিত হয়েই চলৰে৷ অর্থাৎ শ্রেণী-সংগ্রাম চলার সঙ্গে সঙ্গে কোন বিশেষ যুগে কোন বিশেষ গোষ্ঠী প্রাধান্য বিস্তার করবে৷ এখন বিজ্ঞান যদি পুরোপুরি তমোগুণী মানুষের আয়ত্তে থাকে তাহলে তার ফলও হৰে নৈরাশ্যজনক৷ সেক্ষেত্রে আশার কথা এই যে, যদি ক্রমাগত কদর্য শ্রেণীসংগ্রাম চলতে থাকে তো শেষ অবধি মানুষ ৰুঝবে যে একমাত্র সদ্বিপ্র ব্যতিরেকে আর কেউই সমাজের নেতা হতে পারে না৷ যাঁরা যম-নিয়মাদি নীতিগুলোকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেন, তাদেরই ৰকলমে সদ্বিপ্র৷ এদের সামূহিক প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবপ্রগতি তথা শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্ণ সম্ভাবনা৷ গণতন্ত্রও মানুষের সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়, কারণ গণতন্ত্রের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক প্রাধান্য বিস্তারের চরম সুযোগ পায়, অন্যদিকে আরেক দলের স্বাধীনতা ৰেশ কিছুটা ক্ষুণ্ণ্ হয়৷ যেহেতু গণতন্ত্রে কোন নীতিকেই চূড়ান্ত ৰলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, তাই সহসা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষা, হীনতা, অনৈতিকতা ইত্যাদি অয়াধে নিকড় গাড়বার সুযোগ পায়৷ অধিকন্তু, আপেক্ষিক সত্যগুলোকে নীতি হিসেবে পুনঃ পুনঃ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে গণতন্ত্রের বর্ণ ও আকার পরিৰর্তিত হয়ে থাকে৷ শ্রেণীহীন সমাজ-প্রতিষ্ঠা একমাত্র তাঁরাই করতে পারেন যাঁরা পরমপুরুষকে নিজের জীবনের লক্ষ্য করে নিয়েছেন ও যাঁদের সমগ্র মানস-শক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই একই লক্ষ্যের দিকে প্রলম্বিত বা প্রযুক্ত হয়ে থাকে৷ শ্রেণী-সংগ্রামহীন সমাজে বাকি সকল শ্রেণীকে বিলীন হতেই হৰে ও সমস্ত মানুগুলোকে একই আদর্শের আঙ্গিনায় এসে সমবেত হতে হৰে৷ একমাত্র সদ্বিপ্রদের দ্বারাই এটা সম্ভব হতে পারে ও এজন্যেই বিশ্বের কল্যাণার্থে সদ্বিপ্রদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন৷ গণতন্ত্রের আওতায় এই ধরণের আদর্শের প্রতিষ্ঠা মোটেই সম্ভব নয়, কেন না সেখানে বোটপাবার জন্যে চোর, ডাকাত তথা নানান ধরণের সমাজ-বিরোধী মানুষের দ্বারস্থ হতে হয়৷ জাতিভেদ, প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির ধুয়া তুলে সমর্থ ও যোগ্য প্রার্থীদের পরাজিত করা হয় আর যারা রাজনীতি, শাসন পরিচালনা, শিক্ষা, ৰুদ্ধিমত্তা, নীতি ইত্যাদি বিষয়ে একেবারে অনভিজ্ঞ, তারাই প্রতিনিধিদের ভাগ্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পেয়ে থাকে৷
সদ্বিপ্রের দ্বারা বিজ্ঞানের যথার্থ অনুশীলনের ফলে ব্যষ্টিগত তথা সামাজিক বহু সমস্যার সুন্দর সমাধান হতে পারে৷ পৃথিবীর সকল দেশেই আজও কমৰেশী যে ভূমি-সমস্যা রয়েচে, বিজ্ঞান অনেকাংশে তার একটা সহজ সমাধান করে দিতে সক্ষম৷ খাদ্য-সামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা কম থাকলেই ভূমির গুরুত্ব তথা মূল্য আপনিই কমে যাৰে৷ মানুষের ক্ষুধা নিবারণের জন্যে একটা বটিকাই যথেষ্ট হতে পারে৷ বৈজ্ঞানিকের গবেষণাগারে এই ধরণের অনেক পরিমাণ বটিকা উৎপাদন ধনী-দরিদ্রের ভেদও অনেক ঘুচিয়ে দেৰে, কারণ পাকস্থলীর জ্বালা দূর করার জন্যেই গরীবেরা ৰাধ্য হয়ে ধনীর দাসত্ব স্বীকার করে ও এভাবেই তার অধিকতর ধনাগমের সুযোগ করে দেয়৷ অবশ্য এরকমের সূক্ষ্ম খাদ্য উৎপত্তির আগে থেকেই বিজ্ঞান নানান উপায়ে খাদ্য-সমস্যার সমাধানে সহায়তা করছে৷ জনসংখ্যা ৰেড়েই চলেছে, ার তুলনায় জমির প্ররিমাণ ৰাড়ছে না৷ এই সীমিত ভূ-ভাগ নিয়েই লোকেরা বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নত ধরণের সার, শস্যবীজ, জলসেচ-ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ ৰাড়িয়ে নিচ্ছে৷ তাহলেই দেখছি, মানব-প্রগতির পক্ষে বিজ্ঞান অত্যাবশ্যক, নতুবা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে আজ অনাহারে শুকিয়ে মরতে হ’ত৷
আমরা জানি, চিকিৎসা-বিজ্ঞান অতীতেও মানুষকে প্রচুর সাহায্য করেছে, বর্তমানেও করছে ও অনুরূপভাবে ভবিষ্যতেও করৰে৷ উন্নত ঔষধ ও শল্যচিকিৎসা মানুষকে দীর্ঘায়ু করার জন্যে অতীতে ও বর্তমানে সমানভাবে সহায়তা করেছে ও করছে৷ মানুষ যদি দেহের পুরানো গ্রন্থিকে বাদ দিয়ে নোতুন গ্রন্থি সংযোজিত করতে পারে তো চাই কি---মানুষ বার্ধক্য ও মৃত্যুকেও ঠেকিয়ে রাখতে পারে৷ চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ তাও সাফল্যের সঙ্গে করেছে ও করছে৷ জীবদেহের মৃত্যু ঘটে তার দেহস্থিত গ্রন্থিগুলো পুরানো ও দুর্ৰল হয়ে পড়ে ৰলে৷ কাজেই এগুলোকে পাল্টানোর ফলে মৃত্যুকেও পিছু হঠতে হয়৷
অবশ্য জীবৎকালটাকে কিঞ্চিৎ দীর্ঘ করে বা সাময়িকভাবে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখে মানুষ কিন্তু অমর হৰে না৷ কারণ তার আরও একটা জিনিস রয়েছে---মস্তিষ্ক৷ এই মস্তিষ্ক থেকেই মানুষের ‘‘আমি আছি’’, ‘‘আমি করছি’’ ইত্যাদি মানসিক ভাবগুলো উদ্ভূত হয়ে থাকে৷ প্রাচীনতা তথা ক্রমাগত ব্যবহারের দরুণ মস্তিষ্কের মধ্যে অবক্ষয়-নিৰন্ধন বিকৃতি দেখা দেওয়া স্বাভাবিক৷ যদি এই মস্তিষ্কটাকে পালটিয়ে ফেলা হয়, সেক্ষেত্রে মানুষের পুরো ব্যষ্টিত্বটাই পরিবর্তিত হয়ে অন্য রূপ নেৰে৷ তখন কিন্তু পুর্বের মানুষটার মৃত্যু হয়ে নোতুন মানুষের জন্ম হয়েছে---এই রকম মনে করতে হৰে৷ উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা, মানবদেহে গ্রন্থিগত পরিবর্তন ঘটানো যায়৷ ফলতঃ অসৎকেও সৎ মানুষে পরিণত করা যায়৷ কিন্তু এর দ্বারা মানুষের পূর্বার্জিত সংস্কারের কোন পরিবর্তন সাধন হৰে না৷ অবশ্য এতে জীবের প্রত্যয়মূলক কর্মের ধারাকে বদলানো যেতে পারে কিন্তু সংস্কারমূলক কর্মের ধারাকে রোধ করা যাবে না৷ মস্তিষ্ক মনের আধার, আর মন হচ্ছে সংস্কারগুলোর অধিষ্ঠানস্থল৷ এখন মস্তিষ্কের পরিবর্তনের ফলে মন তার সমস্ত সংস্কার সমেত নোতুন একটা আশ্রয় নেৰে ও সেক্ষেত্রে সেটা হৰে সম্পূর্ণ নোতুন একটা সত্তা৷ বিজ্ঞানের ৰলে মানুষের মস্তিষ্কটাকে ৰদলে দিয়ে যদি বানরের মস্তিষ্ক সংযুক্ত করা হয়, তাহলে সেই পূর্বেকার মানব-দেহটার মালিক এখন থেকে আর সে নয়৷ মনস্তত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, সে মোটেই মানুষ নয় আর তার গ্রন্থিগুলো থেকে রসক্ষরণও ৰানরদেহের গ্রন্থির রসক্ষরণের অনুরূপই হচ্ছে৷ ঠিক এইভাৰেই পুরুষকে স্ত্রীতে ও স্ত্রীলোককে পুরুষে পরিণত করা আদৌ অসম্ভব নয়৷ শুধু তাই নয়, শক্তিশালী মানসিক ভাবগ্রহণের মাধ্যমে গ্রন্থির রসক্ষরণেও পরিবর্তন আনা যেতে পারে৷ ফলে পুরুষ নারীতে ও নারী পুরুষে রূপান্তরিত হতে পারে৷ আর গ্রন্থিগুলোর আংশিক পরিবর্তনের দ্বারা পুরুষের পক্ষে গর্ভধারণ করা অসম্ভৰ হৰে না৷ কিন্তু বিজ্ঞান মানুষের সংস্কারকে কদাপি পরিবর্তিত করতে পারে না৷ কাজেই মানুষের পক্ষে ব্যষ্টিত্ব-বিকাশের জন্যে আধ্যাত্মিক সাধনা ছাড়া গত্যন্তর নেই৷
মানব-প্রগতির জন্যেই আমরা বিজ্ঞানচর্চাকে অভিনন্দন জানাই৷ কিন্তু এই বিজ্ঞান-চর্চা অবশ্যই সদবিপ্রদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়৷
এমন একদিন আসৰে যখন মানুষ বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার থেকেই মানবশিশুর জন্ম দেৰে৷ শুধু তাই নয় সেখান থেকেই শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের উদ্ভব হৰে৷ তখন ধীরে ধীরে মানুষ সন্তান-জননশক্তি হারিয়ে ফেলৰে কিন্তু তার সর্জন-ধর্মী আবেগ কোনদিনই মন থেকে নষ্ট হৰে না৷ যেহেতু মূল স্রষ্টা সগুণ-ৰ্রন্মের মধ্যে সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, সেই হেতু তাঁতেই বিধৃত সমস্ত মানুষের মধ্যেই সৃষ্টির ৰীজ থাকা সম্ভব৷ সেই শুভদিনে মানুষ কামময় কোষের ৰেড়া ডিঙ্গিয়ে সূক্ষ্মত্বের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তার সৃষ্টির ইচ্ছাকে চরিতার্থ করৰে৷ সেদিনের মানুষগুলো সুন্দরতর সমাজ তৈরী করে মহান্ সাহিত্য, অধিকতর প্রগতিশীল শিল্প-কলার জন্ম দেৰে৷
আমার ব্যষ্টিগত মত এই যে, আণবিক ৰোমা কখনও মানব সভ্যতাকে পরিপূর্ণ ধবংস করতে পারে না কারণ মানুষ ৰুদ্ধির দিক থেকে এখনও সসম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যায় নি৷ মানব-মনে বিদ্যা-অবিদ্যার সংগ্রাম এখন বেশ সুন্দরভাবে চলছে৷ সেইজন্যে আমি এই পরিষ্কার সিদ্ধান্তে না পৌঁছে পারি না যে, অতি অদূর ভবিষ্যতে মানুষ আণবিক ৰোমা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করৰেই ও সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের যে মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে একটা মহান ভূমিকা রয়েছে তারও প্রতিষ্ঠা হৰে৷