বিশ্বস্রষ্টা বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ৷ সৃষ্টিচক্রের সঞ্চর প্রতি সঞ্চর ধারায় চুড়ান্ত পর্যায় সুন্দর অবয়ব, সমুন্নত মেধা, বুদ্ধি, বিবেক, বোধি-দিয়ে পরমপিতা,মানব জাতির সৃষ্টি করেছেন---বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, বিশেষ প্রত্যাশা নিয়ে, অমৃতের সন্তানরূপে অমৃতত্ত্ব লাভ করানোর জন্যে৷ এজন্য মানুষের প্রয়োজনে যুগসন্ধিক্ষণে তারকব্রহ্ম রূপে, মহাসম্ভূতি রূপে পরম করুণাময় বিশ্বপিতা ধরার ধুলিতে অবতীর্ণ হয়ে-মানুষকে সঠিক পথের পথ নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন,চলার পথকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছেন৷ তথাপি মানুষ হুঁস---হারিয়ে, স্বধর্ম বিসর্জন দিয়ে উন্মত্তের ন্যায় উনমার্গগামী হয়ে চলেছে৷ তাই আজ বর্তমান মানব সমাজে ব্যষ্টিগত ও সামুহিক জীবনে দেখা যাচ্ছে চরম অবক্ষয়, নেমে এসেছে নীতিহীনতার, অজ্ঞানতার, ভাবজড়তার, দাম্ভিকতার ঘনঘোর অন্ধকার৷ কিন্তু, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়৷ এহেন নিদারুন করুন অবস্থাটা বিশ্বস্রষ্টার অভিপ্রেত নয়৷ বিধাতা পুরুষ অনেক আশা ও বিশ্বাস নিয়ে মানুষকে অবাধ স্বাধীনতা ও অপরিমেয় সার্বভৌম শক্তি দিয়ে, মুক্তিমোক্ষের সিংহদ্বারের দোর গড়ায় উপনীত করে দিয়েছেন৷ কিন্তু মানুষ তার স্বকীয় কর্মদোষে এই মর্মান্তিক শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে৷ এর ফলে সারা বিশ্বে আজ যে চরম সংকটের ও ধবংসোন্মুখ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে--- সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই৷ শারীরিক সুখ, সুস্থতা, মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক আনন্দ মানুষের ব্যষ্টিজীবনে, তথা সামুহিক জীবনে দুর্লভ হয়ে পড়েছে৷ পরিবর্ত্তে মানুষ নানান শারীরিক ও মানষিক ব্যাধির শিকার হয়ে পড়েছে৷ মাথা ব্যাথা, কোমর ব্যাথা, বাত, ক্ষুধামন্দা, অম্ল গ্যাস, রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রোগগুলো আজ ঘরে ঘরে বাসা বেঁধেছে৷ অপরদিকে নানাহীন বৃত্তির প্রকোপে মানসিক যন্ত্রণাও মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে৷ তদুপরি বিভিন্ন প্রকার ভাইরাস-জনিত মারণরোগের প্রাদুর্ভাবে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে৷ প্রতিটি মানুষ আজ মৃত্যুর ভয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত৷ এহেন করুন পরিণতি মানুষের কর্মফল ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ কর্মফল মানুষকে ভোগ করতেই হবে৷ এর কোন অন্যথা হবার নয়৷ প্রসঙ্গত স্মরণীয় মনুষ্যেতর জীবের কোন কর্মফল ভোগ করতে হয় না, কারণ সেগুলি প্রকৃতি দত্ত বৃত্তি বা প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়৷ তাদের উত্তরন হয় প্রাকৃতিক নিয়মেই৷
কিন্তু অতীব শৃঙ্খলা পরায়ণা প্রকৃতি মানুষেরও উত্তরন ঘটাবে মানুষ যদি স্বধর্মের অনুশীলন করে উত্তরণের জন্য যথাযথ প্রয়াস করে৷ অমৃতের সন্তান মানুষকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সদা সর্বদা আগ্রহী প্রকৃতি৷ আর যে মানুষ ঈশ্বর নির্দিষ্ট স্বধর্মের অবমাননা করে আদর্শচূ্যত হয়ে দুর্নীতি পরায়ণ দুষৃকতির মত আচরণ ক’রে অন্তরের অভ্যন্তরে এবং বাহিরে ধন, মান, জ্ঞানের অহঙ্কারে আষ্ফালনে ভদ্রবেশীরূপে আত্মপ্রকাশ করে--- প্রকৃতি তাদের জন্য --- যথোপযুক্ত শাস্তি দানের ব্যবস্থা করেন৷ পবিত্র গীতায় শ্রীকৃষ্ণের অমোঘবাণী ‘সম্ভাবামি যুগে যুগে’ বানীর অনুরণনে আবির্ভূত তারকব্রহ্ম, মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী উদাত্ত কন্ঠে ঘোষনা করেছেন, ‘‘শ্রীকৃষ্ণেরমত সারথী হয়ে দুষৃকতি দমনের ব্যবস্থা করবো৷’’ কারণ তারাও আমার স্নেহের সন্তান৷ তাদের দমন পীড়নের দায়িত্ব প্রকৃতির হস্তেই অর্পন করলাম৷’’
তিনি এইসব দুর্নীতি পরায়ন মানুষরূপী জানোয়ারদের (পশুদের) বলেছেন--- মার্জিত শয়তান আর যারা সাধারণ মানুষরূপী মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে সৎভাবে সৎকর্ম করে নিষ্পৃহ হয়ে উত্তরণের জন্য আদৌও আগ্রহী নন, তাঁরা সৎকর্মের কর্মফল জাগতিক সুখ ভোগ করে জন্ম-মৃত্যুর গড্ডালিকা প্রবাহে কলুর বলদের মত বারে বারে ঘুরতে থাকে৷ উত্তরনের চেষ্টা,প্রয়াস, যোগসাধনা না করার জন্য তাদের উর্দ্ধগতি অর্থাৎ দেবত্বপ্রাপ্তি বা মুক্তিমোক্ষ প্রাপ্তি হয় না৷ এটাও ঘটে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই৷ এই নিয়মটি হচ্ছে--- এ পৃথিবীর ও মহাবিশ্বের সবকিছুই গতিশীল৷ কোন কিছুই স্থির নয়৷ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, আমাদের পৃথিবী---সব কিছুই অবিরামভাবে চলে চলেছে৷ গতিশীল বলে পৃথিবীর আর এক নাম জগৎ (যা গম্্ ধাতু নিষ্পন্ন)৷ জগৎ গুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন,’’ যে ওপরে উঠার চেষ্টা করে না, তাঁর অধোগতি অনিবার্য৷ কারণ সে স্থির হয়ে থাকতে পারে না৷ সে যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাবে তা হতে পারে না৷’’
নানান গবেষনালব্ধ তথ্যসূত্র থেকে জানা গেছে, মানুষের এই চরম শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক অস্থিরতার পিছনে রয়েছে মূলতঃ অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনচর্যা ও অত্যধিক ভোগমুখী জীবনধারা৷ এর ফলে উচ্ছৃঙ্খল জীবনশৈলী ও বিপথগামী চিন্তাধারা আজ সমাজের সর্বস্তরে সঞ্চারিত হয়েছে৷ এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে সমাজে এক আমূল পরিবর্ত্তন দরকার৷ একক তথা সামুহিক জীবনে এক আমূল পরিবর্তন দরকার৷ এক সমুন্নত জীবচর্যা ও জীবনআদর্শকে অনুশীলন করা দরকার,অন্যথায় মানব সমাজ ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ দুর্র্যেগপূর্ণ, তমসাচ্ছন্ন হয়ে উঠবে৷
মানবজাতির এই অবশ্যম্ভাবী চরম সংকট থেকে বাঁচার উপায় কী? উপায় অবশ্যই আছে৷ সেই উপায়টি হচ্ছে,মানুষের জন্য প্রকৃতি দত্ত স্বধর্ম পালন করা৷ স্বধর্ম কী? স্বধর্ম হচ্ছে ভাগবত ধর্ম, মানবধর্ম৷ বিশ্বের প্রতিটি বস্তুর একটি নিজস্ব ধর্ম আছে যা থেকে ঐ বস্তুটিকে চেনা যায়, জানা যায়৷ যেমন---জলের ধর্ম ভিজিয়ে দেওয়া, আগুনের ধর্ম তার দাহিকা শক্তি, বাতাসের ধর্ম প্রবাহিত হওয়া৷ এখানে ধর্ম বলতে বোঝানো হচ্ছে---সংশ্লিষ্ট বস্তুর সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷ তেমনি মানুষের ধর্ম অর্থাৎ সত্তাগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে--- ভাগবত ধর্ম অর্থাৎ ভগবানকে, অর্থাৎ তার স্রষ্টাকে উপলব্ধি করে, তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঐকান্তিক এষণা, সাধনা করা৷ এটাই হচ্ছে--- প্রকৃতির অমোঘ বিধান, পরমস্রষ্টা পরমপুরুষের অভিলাস৷ প্রভাত সঙ্গীতে একথাই বলা হয়েছে,---‘‘তোমার অভিষ্ট, আমার যে ইষ্ট, তুমি বিধু আমি যে চকোর৷’’ এ ব্যাপারে ভারতবর্ষের প্রাচীন মুনি ঋষিদের দেওয়া জীবনধারা ‘‘যোগ’’ নিঃসন্দেহে আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করতে পারে৷ মানুষের সর্বাত্মক উন্নতি ও প্রগতির জন্য ‘অষ্টাঙ্গ যোগ’, এ যোগের প্রতিটি অঙ্গই অপরিহার্য, প্রতিটি অঙ্গই মহত্বপূর্ণ৷ এই অষ্টাঙ্গিক যোগ হচ্ছে--- যম, নিয়ম, আসন প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা, সমাধি৷ পরমাসাধ্য গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মানুষের এই দুরবস্থার কথা ভেবে যোগাসনকে (অষ্টাঙ্গযোগকে) যুগোপযোগী করে প্রতিটি মানুষের দিন চর্যায় নিয়মিতভাবে অনুশীলন করে নেওয়ার কথা বলেছেন৷ আনন্দমার্গ মতে তাই যোগ হল, ‘‘সংযোগ যোগ ইত্যুক্তঃ জীবাত্মা পরমাত্মণ৷’ অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগই হল যোগ৷ যুগবতার শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি সেই সঙ্গে কৌশিকী ও তাণ্ডব--- এই দু’টি অমূল্য যোগনৃত্যকে ‘‘যোগ’’-য়ে যুক্ত করেছেন৷ কৌশিকী নৃত্য শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্তন করেছেন বিশেষ করে নারীজাতির শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের কথা ভেবেই৷ এই কৌশিকী নৃত্য অভ্যাসের মাধ্যমে নারী জাতির ২২টি রোগ প্রতিরোধ করতে পারে৷ পুরুষেরাও এই কৌশিকী নৃত্যের অনুশীলনে উপকৃত হবে যথেষ্ট পরিমানে৷ আর সদাশিব প্রবর্ত্তিত তাণ্ডব নৃত্য পুরুষজাতির পৌরুষত্ব অটুট রাখতে অভাবনীয়ভাবে সাহায্য করে৷ তবে স্ত্রীজাতির পক্ষে তাণ্ডব নৃত্য নিষিদ্ধ তাদের শারীরিক সংরচনার ভিন্নতার জন্য৷ এই দুটি নৃত্য সহ নিয়মিত যোগাসন ও যোগ সাধনা মানুষকে সুস্থ রাখতে ও সুখ-শান্তিময় জীবনঘটনে প্রভুত সাহায্য করতে পারে৷ ব্যষ্টি নিয়েই তো সমাজ৷ যেমন বিন্দু বিন্দু জলকণা নিয়ে সুবিশাল জলধি৷ তাই ব্যষ্টির উন্নতি, প্রগতির মধ্যেই সমাজের সার্বিক উন্নতি ও প্রগতি নিহিত৷
যোগাসন অভ্যাসকালে কিছু বিধি নিষেধ অবশ্যই পালনীয়৷ অন্যথায় উপকারের পরিবর্ত্তে অপকার হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক৷ যেমন একজন ব্যষ্টির পক্ষে শরীরের প্রয়োজন বুঝে ৫টি বা ৬টি আসন করলেই যথেষ্ট৷ আর আসন কারো কাছে শুনে বা বই পড়ে অভ্যাস করা উচিত নয়৷ উপযুক্ত দক্ষ যোগাচার্যের কাছে শিক্ষা নিয়ে যোগাসন বা প্রাণায়াম অভ্যাস করা প্রয়োজন৷ আসন প্রাণায়াম অভ্যাসের সময়,স্থান পরিবেশ ও ব্যাপ্তি ব্যাপারেও আচার্যের নির্দেশ পালন করতে হবে৷ আসন প্রাণায়াম অভ্যাসের সময় আসন উপকারিতা, উপযোগিতার কথা চিন্তা করতে হবে---তাহলে সেগুলি সমধিক সুফলদায়ী হবে৷ যেমন সাষ্ঠাঙ্গ আসন অভ্যাসের সময় মনে মনে ভাব নিতে হবে যে, ‘আমার সমস্ত শরীর জীবনরসে পরিপূরিত হয়ে উঠছে৷ সাষ্ঠাঙ্গাসন ও মৎস্যাসন অভ্যাসের ফলে শরীরের ইন্দ্রগ্রন্থি ও উপেন্দ্রগ্রন্থি সক্রিয় হয়ে উঠে, ফলে থাইরয়েড্ জনিত রোগ প্রতিহত হয়৷ উৎক্ষেপ মুদ্রা অভ্যাসের সময় একটু একটু জল পান করে অভ্যাস করলে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ সেরে যায়৷ চক্রাসন বা অর্ধচক্রাসন অভ্যাস করলে মেরুদণ্ড নমনীয় ও সোজা থাকে৷ এর ফলে যৌবনকাল দীর্ঘায়িত হয় ও বার্ধক্য প্রতিহত হয়৷ খালি পেটে,শান্ত মনে, মুক্ত পরিবেশ যোগাসন অভ্যাস করা প্রয়োজন৷ ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ২১শে জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস রূপে পালিত হচ্ছে৷ আসলে মানুষের শরীর হচ্ছে একটি বায়োলজিক্যাল মেশিন৷ যান্ত্রিক মেশিনকে চালু রাখতে হলে যেমন তার বিভিন্ন যন্ত্রাংশকে সঠিকভাবে সচল রাখতে হবে৷ যেমন মেশিনের ইঞ্জিন, গিয়ার, হ্যান্ডেল, ব্রেক ইত্যাদি যথোচিতভাবে সক্রিয় থাকলে সেই যানবাহনের ইঞ্জিন তার আরোহীকে তার গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দিতে সমর্থ হবে, তেমনি শরীর রূপ ইঞ্জিন ঠিক মত সক্রিয় ও সতেজ থাকলে ব্যষ্টিমানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে অর্থাৎ সুস্থভাবে সচ্চিদানন্দ ধামে পৌঁছে দিতে সমর্থ হবে৷ এজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে---‘‘আত্মানম্ রথীনম্ বিদ্ধি, শরীরম রথমেবতু৷ বুদ্ধিংতু সারথীং বিদ্ধি, মন প্রগ্রহমেব চ৷
- Log in to post comments