সন্ধ্যায় নির্জনে ভ্রমণের অভ্যাস প্রভাতরঞ্জনের চিরদিনের জামালপুরে থাকাকালীনও তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাহাড়ের পাদদেশে, লেকের ধারে বা বাঘের কবরে যেতেন নির্জনে একাকী বসে কাজের চিন্তায় মগ্ণ থাকতেন কলকাতায় এসেও তাঁর এই অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি গঙ্গার ধারে বেড়াতে যেতেন তখনকার গঙ্গার কিনারা আজকের মতো এমন জনবহুল ছিল না শান্ত ছিল, নিস্তব্ধ ছিল।
এমনি এক শুভ সন্ধ্যার কথা দিনটা ছিল ১৯৩৯ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমা দীর্ঘ সান্ধ্যভ্রমণ শেষে যুবক প্রভাতরঞ্জন বসে ছিলেন কাশীমিত্র ঘাটে একটা বড় গাছের নীচে, গঙ্গাভিমুখে কল্পনার আল্পনা আঁখছিলেন মানসপটে চারিদিক নিস্তব্ধ মেঘলা আকাশে আলো আঁধারের লুকোচুরি বৃষ্টির আশঙ্কায় নীরবতা চিকে দাদুরীর কর্ণ ভেদী কন্ঠস্বর ভরা ভগীরথে স্মিত জ্যোৎস্নার প্লাবন।
উচ্ছ্বল তরঙ্গের ছলাৎ ছলাৎ ছান্দশীল ধবনি সেই গা ছম ছম করা পরিবেশে প্রভাতরঞ্জনের কানে ভেসে এল এক স্পষ্ট পদধবনি।
পেছন না ফিরেই শান্তস্বরে তিনি বলে উঠলেন,
কে তুমি কি চাও
মূহূর্তে সামনে এসে দাঁড়াল এক ভয়ঙ্কর মানুষ দৈত্যাকার চেহারা, লম্বা ঘন দাড়ি-গোঁফ, ভয়াবহ অবয়ব চকচকে এক ধারাল ছুরি দেখিয়ে বলল--- প্রাণে যদি বাঁচতে চাও টাকা পয়সা ও মূল্যবান যা কিছু আছে দিয়ে দাও আমাকে নিষ্কম্পচিত্তে প্রভাতরঞ্জন বললেন---
আমি একজন ছাত্র একজন ছাত্রের কাছে কি এমন মূল্যবান জিনিস তুমি আসা করতে পারো
একটু থেমে গিয়ে আবার তিনি বললেন, কালীচরণ, আগে তুমি পকেট কাটতে, তারপর চোর হলে, আর এখন তুমি কলকাতার এক দুর্দ্ধর্স ডাকাত জীবনে একি করেছো তুমি তুমি কি ভেবেছো এভাবে তোমার মানব জীবনটা সার্থক হবে ।
কালীচরণযুবকের মুখে নিজের নামটা শোণা মাত্র ডাকাতটির দেহে মনে প্রচণ্ড এক শিহরণ জেগে উঠল এত মধুরস্বরে, এত ভালোবেসে, এত াপন করে, আজ পর্যন্ত কেউ তো তাকে ডাকেনি আমার নামই বা যুবক জানল কি করে! অনেক চেষ্টা করেও ডাকাত কালীচরণ আর নিজের ভাবমূর্ত্তি ধরে রাখতে পারল না অনুতাপে দগ্দ হয়ে চাপাস্বরে বলল--- জানি আমি ভূল পথে চলেছি আর এটা আমার এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, চাইলেও আমি আর এ পথ ছাড়তে পারবো না।
কে বলেছে কালীচরণ মানুষ সব পারে চুরি যেমন তুমি ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করেছো, তেমনি চাইলে ভালো কাজ করতে করতে সেটাই তোমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে।
কালীচরণের মনে যুবকটির প্রতি যেন এক গভীর শ্রদ্ধা জেগে উঠল এই প্রথম কেউ তাকে সুপথে আসার কথা আন্তরিকভাবে বলছে তাঁর কথায় সে মন্ত্রমুগ্দ হয়ে গেল।
প্রভাতরঞ্জন মৃদু হেসে বললেন, কালীচরণ, তুমি চাইলে আমি তোমাকে পথ দেখাতে পারি সুপথে চলে ভালোমানুষ হওয়ার জন্যে তোমাকে সাহায্য করতে পারি তুমি চুরি করে আমার কাছে যা পেতে তার থেকেও অনেক মূল্যবান জিনিষ আমি তোমাকে দিতে পারি তুমি কি নেবে।
যে ডাকাতের নাম শুণে সবাই ভয়ে কাঁপে, সে এখন একেবারে অসহায় অশক্ত যুবকটির মন-মাতানো মৃদু হাসি, বিরাট আকর্ষণীয় সৌম্যমূর্ত্তি তাকে যেন মোহিত করে দিল ধীরে ধীরে তার ভাবান্তর হল অশ্রুসজল চোখে কাতর কন্ঠে সে বলল, তুমি কি দিতে চাও আমাকে।
যাও, ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গঙ্গায় স্নান করে এসো।
সুবোধ বালকের মতো কালীচরণ ছুরি ফেলে স্নান করে সিক্ত বসনে এসে বসল প্রভাতরঞ্জনের সামনে করজোড়ে সাশ্রু নয়নে তার মনে হল মেঘমুক্ত আকাশের মতো সে এখন অনেকটা নির্ভার সে এখন ক্লেদমুক্ত অতীতের সঞ্চিত বিরাট পাপের বোঝা তার মাথা থেকে কেউ যেন টেনে নামিয়ে দিয়েছে সে নির্জন নিশীথে একান্তে বসে প্রভাতরঞ্জন কালীচরণকে বোঝালেন মানব জীবনের লক্ষ্য কী কীভাবে নৈতিক পথ ধরে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয় তাকে শপথ করালেন,সে যেন জীবনে আর কোনো অনৈতিক কাজ না করে তারপর তিনি ধরা দিলেন গুরু রূপে সেই পূণ্যলগ্ণে তিন তাঁকে সাধনা শেখালেন কালীচরণের গুরুকরণ হলো।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অভিনব সাধনা পদ্ধতির প্রবর্তন হল যোগ ও তন্ত্র নির্ভর মানসাধ্যাত্মিক সাধনা ঈশ্বর সম্প্রাপ্তির সাধনা বৃহদেষণার প্রণিধান আধ্যাত্মিক জগতে তৈরী হল এক সোনালী রাজপথ আলোর পথ, অমৃতের পথ, আনন্দের পথ সত্য শিব ও সুন্দরের পথ লক্ষ লক্ষ কালীচরণ আজ সেই পথের পথিক সেই সাধন পদ্ধতির একনিষ্ঠ সাধক মানবসভ্যতার ইতিহাসে সূত্রপাত হলো এক নোতুন যুগের এক আলোকোজ্বল পথের যে পথ সমস্ত অন্ধকার দূরে সরিয়ে মানুষকে নির্মেঘ আনন্দের দেশে নিয়ে যাবে এখানে লক্ষণীয় একটা বিষয় রয়েছে কলকাতায় থাকাকালীন প্রভাতরঞ্জনের সাহচর্যে অনেক জ্ঞানীগুণী বিদগ্দজন এসেছেন অথচ এদের মধ্যে কাউকে তিনি প্রথম দীক্ষা দিলেন না দিলেন এক তথাকথিত দুবৃর্ত্তকে--- একজন ডাকাতকে এর কারণ কী।
এর কারণ ভালোকে ভালো করা সহজ কাজ, ভালোমানুষ বা ভালোপথের মানুষ নিজের প্রচেষ্টাতেও আলোর পথে এগিয়ে যেতে পারে, আজ অথবা কাল মুক্তি মোক্ষ পেতে পারে কিন্তু যে পাপের পাঁকে ডুবে ছট্ফট্ করছে, যার ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারে, তার মুক্তির দ্বার কে খুলে দেবে! তাকে সুপথে কে টেনে আনবে! একমাত্র গুরুই এই কাজ করতে পারেন তাই তো তিনি পতিত পাবন তিনি পাপহারী তিনি বলেছেন, ভালোমন্দ সকলেই আমার প্রিয় সন্তান ভালো ছেলেরা যদি আমার ডান কোলে বসে থাকে, মন্দরাও আমার বাম কোলে বসে থাকে কাউকেই আমি অবজ্ঞা অনাদর করতে পারি না বাস্তবে দেখা গেছে, ভালোমানুষদের তিনি কাছে তো টেনেছেন তবে সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন পাপী-তাপি,অসহায় অনাদৃতদের জন্য কত অবহেলিত পাপী-পাতকি যে তার অভয় শরণে এসে ধন্য হয়েছে, কত অমানুষকে যে তিনি নিজের হাতে মানুষ করেছেন তার হিসেব নেই ডাকাত কালীচরণকে সাধনা শিখিয়ে তিনি সেই বার্র্তই হয়তো দিতে চেয়েছিলেন।
- Log in to post comments