সর্বাত্মক  মুক্তির আদর্শ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

১৯৮২ সালে ২৫শে মার্চ হাওড়া জেলার রামরাজাতলায় আনন্দমার্গের এক ধর্ম মহাসম্মেলন হচ্ছে ৷ তাতে মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী  প্রবচন দেবেন৷ হাজার  হাজার আনন্দমার্গীর সমাবেশ হয়েছে৷ প্যান্ডেলের বাইরেও আনন্দমার্গের পাবলিকেশনের বইয়ের দোকান৷ লোকে ভীড় করে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর আধ্যাত্মিক দর্শন, সমাজদর্শন, ‘প্রাউট’, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকারণ, প্রভাতসঙ্গীত, গল্প, নাটক, শিশুসাহিত্য, যৌগিক চিকিৎসা, দ্রব্যগুণ  প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের বই দেখছেন --- কিনছেন৷ আচার্য ত্র্যম্বকেশরানন্দজী ও অন্যান্য কয়েকজন আনন্দমার্গী আগ্রহী মানুষজনের সঙ্গে  কথাবার্র্ত বলছেন, এমন সময় একদল কলেজের ছাত্র এল৷ তারাও বিভিন্ন বই দেখছিল৷ তারা আচার্য ত্র্যম্বকেশরানন্দজী সঙ্গে কথা বলতে বলতে  জিজ্ঞেস করলেন,  প্রকৃত গুরু কাকে বলব?

ঠিক এই সময় শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর গাড়ি প্যান্ডেলে প্রবেশ করে৷   সঙ্গে সঙ্গে আনন্দমার্গীরা  যথারীতি জয়ধবনি দিতে শুরু করলেন ও প্যান্ডেলের বাইরে যারা ছিলেন ছোটাছুটি করে প্যান্ডেলে প্রবেশ  করার তাড়াহুড়ো পড়ে গেলো৷

আচার্য ত্র্যম্বকেশরানন্দজী তখন ওই ছেলেদের বললেন,  আমাদের গুরুদেব প্যান্ডেলে এসে গেছেন৷ এখন উনি প্রবচন দেবেন৷ আমাকে ভেতরে যেতে হবে ৷ আপনারা গুরুদেবের প্রবচন শুনুন৷ প্রবচনের পরে আপনাদের সমস্ত প্রশ্ণের উত্তর দেব৷

এই বলে ত্র্যম্বকেশরানন্দজী তাড়াতাড়ি প্যান্ডেলের ভেতরে প্রবেশ করলেন৷ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী  মঞ্চে বসেই  বললেন, আজকের আলোচ্য বিষয় ‘প্রকৃত গুরু কে?’

ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দজ্ চমকে গেলেন, সম্ববতঃ ওই ছেলেরাও চমকে গেল৷ আচার্য ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দজ্  পরে বলেছিলেন,  তিনি  ভাবছিলেন ওরা কলেজের শিক্ষিত ছেলে,ওদের ঠিক কি উত্তর দেবেন৷  অন্তর্যামী াাই মনের কথা  জেনে সেই উত্তর তাঁর প্রবচনে দিতে শুরু করলেন---খুবই পুরোনো বৈদিক শব্দ হচ্ছে ‘গুরু’ ,আর তার মানে হচ্ছে যিনি অন্ধকার দূর করে দেন, কিন্তু অন্ধকার দুর করে দেন কথাটা অনেকসময় খুব আলগা ভাবে ব্যবহার করাও হয়৷ এই অন্ধকারতো কেবল মানুষের মনের অন্ধকার নয়, কেবল আত্মার অন্ধকার নয়৷ অর্র্থৎ ত্রিস্তরেই অন্ধকার রয়েছে৷ ত্রি-স্তরে মানেই স্থূলজগতে, মনোজগতে, আত্মিক জগতে--- তিনেতেই অন্ধকার রয়েছে৷

সুতরাং গুরু অর্র্থৎ যিনি অন্ধকার দূর করে দেন৷ তাঁকে ত্রি-স্তরীয় গুরু হতে হবে৷

কারণ, শরীর , মন , আত্মা নিয়ে--- ‘অস্তি’,  ‘ভাতি’ ও ‘আনন্দ’ নিয়ে  মানুষের জীবন৷ অর্র্থৎ আগে মানুষকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে৷ অস্তিত্ব রক্ষা করতে গেলে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা,চিকিৎসা ও বাসস্থানের প্রয়োজন৷ সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্যে যা প্রয়োজন তা চাই৷ তারপর মনের বিকাশ  ঘটাতে  ও জীবনের সর্বোচ্চ  লক্ষ্য জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটিয়ে পরমানন্দ লাভ করতে হবে৷ তাই প্রকৃত গুরুকে কেবল আধ্যাত্মিক গুরু হলেই চলবে না৷ ব্যষ্টিগত জীবন ও সমাজ জীবনের সমস্ত সমস্যারই সমাধানের যথার্থ পথ প্রদর্শন করতে হবে৷

এই দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ছিলেন আদর্শ গুরু৷  তিনি একাধারে আধ্যাত্মিক গুরু, তার সঙ্গে সঙ্গে যুগান্তকারী সমাজদর্শন---‘প্রাউটে’র প্রবক্তা, শিক্ষা, শিল্প--- সাহিত্য, সঙ্গীত, চিকিৎসা প্রভৃতি সমস্ত বিষয়েই আজ  সমাজে যে অবক্ষয় ও বিভ্রান্তি  চলেছে, অজস্র সমস্যার পাহাড়  জমে --- সমস্ত ক্ষেত্রেই সমস্ত সমস্যারই তিনি সমাধানের পথ দিয়েছেন৷

সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যা মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গে একান্তভাবে যুক্ত, সেই সমস্ত সমস্যারও সমাধান দিয়েছেন৷ তিনি সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনের নূন্যতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি, প্রতিটি মানুষের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান ও কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করার জন্যে প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছেন৷

নিপীড়িত মানবতার মুক্তি বিধানে আজকের দুনিয়ায় পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদ ---উভয়েরই ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে তার এই নোতুন দর্শন চিন্তাশীল  ও হতাশাগ্রস্ত  মানুষের সামনে নোতুন আশার আলো জ্বালিয়েছেন৷

শিক্ষার ক্ষেত্রেও  শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে বর্তমানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে,  তা বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষ কেবল অর্থ রোজগারের যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে৷ কিন্তু হারাচ্ছে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলি৷ তারই প্রতিফলন ব্যাপকভাবে আমরা  দেখতে পাই আজকের সমাজে৷  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সেখানে দিয়েছেন নব্যমানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থা৷

আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ধর্মের নামে অজস্র কুসংস্কার, জাত-পাত সাম্প্রদায়িক বিভেদ বিদ্বেষ চলছে, সেই সমস্ত কুসংস্কারের জঞ্জাল থেকে ধর্মকে মুক্ত করে যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক আধ্যাত্মিক দর্শন, সাধনা পদ্ধতি ও নূতন সমাজশাস্ত্র ‘চর্যাচর্য’ দিয়েছেন৷ 

জীবনের সর্বক্ষেত্রই যখন তমসাচ্ছন্ন, শাসক-শোষকের অশুভ আঁতাত নখ দাঁত বার করে বিভীষিকা বিস্তার করছে, নিষ্ঠুর উদ্দাম দানবিকতা গ্রাস করছে সমাজকে তখনই তমসা ভেদ করে পরিত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হলেন আনন্দমূর্ত্তিজী, আলোর আমেজ ছড়িয়ে দিলেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে৷

২১শে অক্টোবর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী পাঞ্চভৌতিক দেহের মহাপ্রয়াণ দিবসে তিনি এই যে বিশ্বমানবতার সর্র্বত্মক মুক্তির আদর্শ দিয়েছেন সেই আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্যে আমাদের সংকল্প বদ্ধ হতে হবে৷