শ্রীরামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে শিবনাথ শাস্ত্রী

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সমকালের বহু জ্ঞানীগুনী সাহিত্যিক পণ্ডিত ভক্ত আর ধর্মানুরাগী ব্যষ্টিদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছিলেন৷ নামী দামী ব্যষ্টিরা ও তাঁর কাছে এসেছিলেন ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করতে৷

শিবনাথ শাস্ত্রী শুধু ব্রাহ্মই ছিলেন না৷ তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে ও নিযুক্ত ছিলেন৷ আর ব্রাহ্মসমাজের নানাবিধ ধর্মীয় ও  সামাজিক আন্দোলনের  তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা৷ তাঁর মতো নিরাকার ব্রহ্মবিশ্বাসী মানুষ কি করে যে একজন পূজারী ব্রাহ্মণের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তা সত্যি আশ্চর্যের বিষয়৷

ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজের একজন সভ্যের শ্বশুর বাড়ি ছিল দক্ষিণেশ্বরে৷ সেই সভ্যের মুখেই শিবনাথ দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণের কথা প্রথম শোণেন৷ সেই পূজারী ব্রাহ্মণের নাকি কিছু বিশেষত্ব আছে৷ ধর্মের জন্য তিনি অনেক দুঃখকষ্ট স্বীকার করেছেন৷ শিবনাথের কৌতূহল হলো পূজারী ব্রাহ্মণের বিশেষত্ব জানবার জন্য৷

এদিকে কেশব সেনও শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে দেখা করে এসেছেন৷ ‘মিরার’ পত্রিকায় তা ফলাও করে ছাপা হয়েছে৷ শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে আলাপ করে তিনি নাকি আনন্দ পেয়েছেন৷

অবশেষে শিবনাথ একদিন দক্ষিণেশ্বরে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে৷ প্রথম দর্শনেই উভয়ের মধ্যে ভাব ভালোবাসা জন্মালো৷ কথা প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ শিবনাথকে বললেন, তিনি কালীমন্দিরের সামান্য একজন পূজারী৷ মন্দিরে অনেক সাধু সন্ন্যাসীর সমাগম হতো৷ তাঁরা যে যা ধর্ম সাধনার পথ বাতলে দিতেন তিনি তাই অনুসরণ করতেন৷ এইভাবে সাধনা করতে করতে তিনি একসময় ক্ষেপে গিয়েছিলেন৷ ঈশ্বরের প্রতি তীব্র আকুতি চরিতার্থ না হওয়ায় উন্মাদ হয়ে গেছলেন৷ তাঁর ভাবসমাধি হতো৷ ভাবাবেশে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়াকে অবশ্য শিবনাথ ‘পীড়া’ মনে করতেন৷ কখনো সখনো দীর্ঘ অদর্শনের পর শিবনাথকে দেখে আনন্দে আলিঙ্গন করতে গিয়ে তার বুকের মধ্যেই তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তেন৷

শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে মিশে কী বুঝেছিলেন শিবনাথ? বুঝেছিলেন, ধর্ম এক---রূপ ভিন্ন ভিন্ন মাত্র৷ শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্ম-চিন্তার ব্যাপ্তি, গভীরত্ব উদারতা ও বিশ্বজনীনতায় শিবনাথ অতীব মুগ্দ হয়েছিলেন৷

একবার শিবনাথ তাঁর এক খ্রীষ্টান পাদরী বন্ধুকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিলেন৷ খ্রীষ্টান বন্ধুটির পরিচয় পেয়েই শ্রীরামকৃষ্ণ স্বভাবসুলভ বিনয়ে মাথা নত করে বললেন, যীশুর চরণে আমার শত শত প্রণাম৷

খ্রীষ্টান পাদরী আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ণ করলেন, যীশুকে আপনি কি মনে করেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ কেন, ঈশ্বরের অবতার৷

শ্রীরামকৃষ্ণ হ্যাঁ, সেইরকম৷ ভগবানের অবতার অসংখ্য, যীশু ও এক অবতার৷

পাদরী ঃ আপনি অবতার  বলতে কী বোঝেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ ঃ সে কেমন তা জানো? আমি শুণেছি, কোন কোন স্থানে সমুদ্রের জল জমে বরফ হয়৷ অনন্ত সমুদ্র পড়ে রয়েছে৷ এক জায়গায় কোন বিশেষ কারণে খানিকটা জল জমে গেলো৷ ধরবার ছোঁবার মতো জল৷ অবতার যেন কতকটা সেইরূপ৷ অনন্তশক্তি জগতে ব্যাপ্ত আছেন, কোন বিশেষ কারণে কোন এক বিশেষ স্থানে খানিকটা ঐশীশক্তি মূর্ত্তি ধারণ করলে, ধরবার ছোঁবার মতো হলো৷ যীশু প্রভৃতি মহাজনদের যে কিছুশক্তি তা ঐশী শক্তি৷ সুতরাং তাঁরা ভগবানের অবতার৷

এ প্রসঙ্গে আনন্দমার্গ দর্শনে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম হতে আমাদের সবার অবতরণ ঘটেছে৷ সেই অর্থে সকল মানুষই অবতার৷

তবে হ্যাঁ, একেবারে সাদামাটা ভাষায় পারিপার্শ্বিক জগতের সহজ উপমা সহযোগে ধর্মের দূরহ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল সহজাত গুণ৷

শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে শিবনাথ ধর্মের সার্বভৌমিকতার ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন৷ পরবর্তীকালে উভয়ের ঘনিষ্ঠতা এতো প্রগাঢ় হয়েছিল যে কিছুদিন দেখা না হলে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই শিবনাথের বাড়িতে আকুল আগ্রহে ছুটে আসতেন৷ বলতেন, তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে৷ শুদ্ধাতনাদের  না দেখলে কি নিয়ে থাকবো? শুদ্ধাত্মাদের পূর্ব জন্মের বন্ধু বলে  মনে হয়৷ শিবনাথ নিজেও ছিলেন ঈশ্বর ভক্ত৷ তাই শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, এই যে শিবনাথ৷ দেখ, তোমরা ভক্ত, তোমাদের দেখে বড় আনন্দ হয়৷ গাঁজাখোরের স্বভাব, আর একজন গাঁজাখোরকে দেখলে ভারী খুশী হয়৷ হয়তো তার সঙ্গে কোলাকুলিই করে৷

ঈশ্বরের ঐশ্বর্য বর্ণনা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিরর্থক মনে হতো৷ একবার তিনি কেশব সেনের বত্তৃণতা শুনতে গিয়েছিলেন৷ সেই বত্তৃণতা প্রসঙ্গেই শিবনাথকে তিনি পরে বলেছিলেন, হ্যাঁ গা, তোমরা ঈশ্বরের ঐশ্বর্য অতো বর্ণনা করবেন? ‘হে ঈশ্বর, তুমি কি সুন্দর ফুল করিয়াছ, তুমি আকাশ করিয়াছ, তুমি তারা করিয়াছ তুমি সমুদ্র করিয়াছ’--- এতসব বলার কী দরকার? যারা  নিজে ঐশ্বর্য ভালবাসে তারা ঈশ্বরের ঐশ্বর্য বর্ণনা করতে ভালবাসে৷ তাঁর অনন্ত সৃষ্টি, অনন্ত ঐশ্বর্য! অতো খবরে আমাদের কাজ কি!