এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে দুই বিপরীতমুখী স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে৷ একটি এনডিএ অপরটি ইন্ডিয়া৷ বঙ্গ রাজনীতির প্রধান কান্ডারী মমতা বন্দোপাধ্যায় ইন্ডিয়া স্রোতে শুধু ভাসছেনই না তিনি এই স্রোতের একজন অতি উৎসাহী নেত্রীও বটে৷
বিজেপিকে দিল্লীর ক্ষমতা থেকে অবশ্যই সরানো দরকার৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লী থেকে বিজেপিকে সরানোর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের লাভ ক্ষতির কথা ভাবতে হবে৷ কারণ কংগ্রেস সিপিএম যে পশ্চিমবাঙলার খুব একটা শুভাকাঙ্ক্ষী নয় তা ৬৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ টের পেয়েছে৷ আমরা একটু পিছনে তাকিয়ে সে ইতিহাসটা দেখে নিই৷
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ঘটনা, ১৯৩৯ সাল৷ গান্ধীর মনোনীত প্রার্থী সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ এতে দেশীয় পুঁজিপতিদের অর্থে পুষ্ট জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধী পটেল নেহেরু লবি মেনে নিতে পারলেন না৷ অতএব সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে তাড়াবার হীন ষড়যন্ত্র শুরু হল এই ত্রয়ীর নেতৃত্বে৷ সুভাষচন্দ্রকে কিছুতেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঘটন করতে দিলেন না জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধী লবির লোকেরা৷ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধীজীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যাতে সুভাষচন্দ্র ওয়ার্কিং কমিটি ঘটন করতে পারেন৷ বিশ্বকবির অনুরোধেও কর্ণপাত করেনি অহিংসার পূজারী (?) মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী৷ সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ ও কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন৷
ব্যাতীত ও অসুস্থ কবি শান্তিনিকেতন থেকে এক ঐতিহাসিক পত্র লিখলেন৷ সেই পত্রে প্রথমেই তিনি লিখলেন---‘‘সুভাষচন্দ্র, বাঙালী কবি আমি, বাংদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়ক হিসেবে বরণ করি৷’’ হ্যাঁ, হিন্দুস্থান বা ভারতবর্ষ নয়, দেশেরও নয়, বাংলাদেশের দেশনায়ক পদে বরণ করেছিলেন বিশ্বকবি সুভাষচন্দ্র বসুকে৷ সেই পথে ছত্রে ছত্রে তিনি বাঙালীর দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে সুভাষচন্দ্রকে বাংলাদেশের দেশনায়কের পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন৷ সুভাষচন্দ্রের কাছে তিনি কি চান তাও তিনি ব্যক্ত করেছেন ওই পত্রে--- ‘‘নানা কারণে আত্মীয় পরের হাতে বাংলাদেশ যতকিছু সুযোগ থেকে বঞ্চিত, ভাগ্যের সেই বিড়ম্বনাকেই সে আপন পৌরুষের আকর্ষণে ভাগ্যের আশীর্বাদে পরিণত করে তুলবে---এই চাই৷’’
‘‘......বাঙালী অদৃষ্ট কর্ত্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না এই আশাকে সমস্ত দেশে তুমি জাগিয়ে তোলো, সাংঘাতিক মার খেয়েও বাঙালী মারের ওপরে মাথা তুলবে৷---’’
পরিশেষে লিখলেন---‘‘ বহুকাল পূর্বে একদিন আর এক সভায় আমি বাঙালী সমাজের অনাগত অধিনায়কের উদ্দেশ্যে বানীদূত পাঠিয়েছিলুম৷ তার বহু বৎসর পরে আজ আর এক অবকাশে বাংলাদেশের অধিনেতাকে প্রত্যক্ষ বরণ করছি৷’’
সুভাষচন্দ্রে মন তখন আচ্ছন্ন ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতায়৷ গোটা দেশ সেই স্রোতেই ভাসছিল৷ তাই বাংলাদেশের অধিনায়ক হতেই তিনি চাইলেন না৷ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনই তার পাখীর চোখ ছিল৷ হয়তো ভেবেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু কংগ্রেসের বাঙালী বিদ্বেষী গান্ধী লবি ষড়যন্ত্র কত হীন নীচ জঘন্য হতে পারে তা সুভাষচন্দ্র অনুমান করতে পারেননি৷ তাই তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আজও অধরাই থেকে গেল, তিনি হারিয়ে গেলেন৷ আজ বাঙালী সর্বনাশের শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে৷
এসব কথার অবতারণা করার কারণ স্বাধীনতার পর খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয়তম নেত্রীর ইন্ডিয়া জোট নিয়ে অতি উৎসাহ৷ বিজেপি দিল্লী থেকে যাক এটা প্রতিটা বাঙালীর মনের কথা৷ কিন্তু এর সঙ্গে বাঙলার লাভক্ষতির অঙ্কটাও হিসেব করা দরকার৷ রবীন্দ্রনাথের পত্রকে আমল না দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ণে বিভোর সুভাষচন্দ্র হারিয়ে গেলেন৷ ভ্রান্ত হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে গিয়ে একই লবির শিকার হয়ে শ্যামাপ্রসাদ হারিয়ে গেলেন৷ শেষ সময়ে নিজের ভুল বুঝতে পারলেও স্বদেশী সাম্রাজ্যবাদী শাসক তাঁকে ভুল সংশোধনের সময় দেয়নি৷ ইন্ডিয়া জোটে সেই কংগ্রেস কমিউনিষ্ট যাঁরা স্বাধীনতার পর ৬৫ বছর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থেকেও বাঙালীর জন্য কিছু করেনি৷ পঞ্জাব যেভাবে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করেছে এরা তার ছিটে ফোটাও করেনি৷ উল্টে বাঙলার শিল্প সাহিত্য সংসৃকতি অর্থনীতি ধবংস হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গ হয়ে গেছে হিন্দুস্থানের উপনিবেশ৷ অপরদিকে দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্রের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমবাঙলায় উত্তর পশ্চিমভারতীয় ধান্দাবাজ দুর্নীতি পরায়ণ রাজনীতির আমদানি করেছে৷ পরস্পরের সংঘাতে অনেক রক্ত এরা ঝরিয়েছে পশ্চিমবাঙলায়৷ আজ ক্ষমতা হারিয়ে হাতে হাত মিলিয়েছে আবার কংগ্রেস কমিউনিষ্ট৷ এদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হবে না৷
ইন্ডিয়া জোটে কোনো বাঙালী যদি মমতা ব্যানার্জীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ণ দেখে সে মুর্খের স্বর্গে বাস করছে৷ আর কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের কতটা ভালো করবে না করবে সে পরের কথা, তবে তৃণমূলে ভাঙন ধরিয়ে মমতার রাজনীতি শেষ করার প্রচেষ্টা করবেই৷ বাঙলার উন্নয়ন অপেক্ষা কংগ্রেস সিপিএমের কাছে এটাই হবে প্রথম কাজ৷ কারণ দুজনেই চরম প্রতিহিংসা পরায়ণ৷ আজ পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সিপিএমের সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল হয়ে যাওয়ার কারণ অবশ্যই মমতা ব্যানার্জী৷ দিল্লীর রাজনীতির স্বার্থে কংগ্রেস বাইরে যতই মমতা প্রীতি দেখাক কিন্তু প্রতিহিংসার জ্বালা তাদের মনে জ্বলছেই৷ যেভাবে গান্ধী নেহেরু লবি ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে সুভাষচন্দ্রকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে সেই একই রাজনীতির ধারা বয়ে চলেছে আজকের কংগ্রেসের উত্তরসূরীর শিরায়৷ তাই প্রিয়রঞ্জন দাস মুনসী, প্রণব মুখার্জীকেও ঘাড় ধাক্কা খেতে হয়েছিল কংগ্রেস থেকেও৷ পৃথক দল গড়ে পাত্তা না পেয়ে গান্ধী পরিবারের দাসত্ব মেনে নিয়ে দুজনেই আবার কংগ্রেসে ফিরে আসে৷ মমতা ব্যানার্জী ব্যতিক্রম৷ তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে পৃথক দল গড়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সিপিএমকে সাইনবোর্ডে পরিণত করেছে৷ বিজেপির ঠেলায় আজ মমতাকে যতই কাছে টানুক সে জ্বালা কিন্তু কংগ্রেস ভুলছে না৷ সঙ্গে দোসর সিপিএমও থাকছে৷
তাই বাঙালী কি আর একবার কাকের থেকেও স্বার্থপর, শিয়ালের থেকেও ধূর্ত, ইংরেজের থেকেও চতুর কংগ্রেস কমিউনিষ্টের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির বলি হবে! নেহেরু থেকে নরেন মোদি দিল্লীর কোন শাসকই বাঙলার শুভাকাঙ্ক্ষী নয়, বাঙলা তাদের কাছে ঔপনিবেশিক শোষণের সোনার খনি৷ তাই রাজনীতিতে বাঙলা ও বাঙালীর যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের ইন্ডিয়া এনডিএ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার কথা ভাবতেই হবে৷
- Log in to post comments