শুভ নববর্ষ প্রসঙ্গে

লেখক
প্রভাত খাঁ

আর কয়েকদিন পরেই বাঙ্লার শুভ নববর্ষ৷ বাংলা ১৪২৪ সাল পেরিয়ে আমরা ১৪২৫–এ পড়ব৷ নোতুন বছরে পা দেব৷ এমনি এক বাংলা নববর্ষের প্রবচনে প্রাউট–প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি একাধারে মহান দার্শনিক, ইতিহাসবিদ্, ভাষাতত্ত্ববিদ্, শিক্ষাবিদ্, সঙ্গীতকার, যিনি মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী রূপে সমধিক পরিচিত, তিনি আত্মবিস্মৃত বাঙালী জাতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল, আজও জীবিত ও আমি আশা করব, ভবিষ্যতে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে৷ সেই জনগোষ্ঠীকে নোতুন করে শপথ নিতে হবে–এই নোতুন বছরটা তারা কীভাবে আরও সফল করে তুলবে৷ নিজেদের অস্তিত্বকে কীভাবে আরও প্রাণবান, প্রাণোচ্ছল করে তুলবে৷’’

নববর্ষে কেবল কি নাচ–গান–উৎসব করেই বাঙালী জাতি হিসেবে আমরা আমাদের কর্তব্য শেষ করব? বাঙালী জাতি কি সার্বিক অবক্ষয়ের পথ ধরে অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্তই হয়ে যাবে? অন্ততঃ তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মধ্যে এই আশংকাই আজ প্রবল হয়ে উঠছে৷ এই অবনমনের প্রবণতা বন্ধ হবে না, যদি না বাঙালী জাতি সম্বিত ফিরে না পায়, আবার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সার্বিক বিকাশের জন্যে সংকল্প গ্রহণ করে কর্মতৎপর না হয়৷

প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘বাঙলার নদী ও সভ্যতা’ বিষয়ক প্রবচনে সভ্যতার ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত এক মৌলিক তত্ত্বে বলেছেন, সভ্যতার উৎপত্তি হয় নদীর পার্বত্য স্তরে৷ তারপর নদী বেয়ে ওই সভ্যতাও এগিয়ে চলে৷ নদী যতই এগিয়ে যায়, অন্যান্য বিভিন্ন নদী ও উপনদী তার সঙ্গে মিলিত হয়, এর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নদী–উপনদী বাহিত সভ্যতাগুলিও একসঙ্গে মিশে বিমিশ্র সভ্যতার সৃষ্টি করে৷ একাধিক মৌলিক সভ্যতার মিলনে ওই বিমিশ্র সভ্যতা সমৃদ্ধতর হয়৷ এইভাবে উন্নততর সভ্যতার সৃষ্টি হয়৷ আর নদীর শেষ স্তরে বদ্বীপ স্তরে ওই সভ্যতা চরম উৎকর্ষ লাভ করে৷ সেদিক থেকে, বিচার করে দেখা যাচ্ছে, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সভ্যতা চরম পরিণতি লাভ করছে বাঙলায় এসে৷ বাঙলায় প্রবেশের সাথে সাথে গঙ্গার বদ্বীপীয় স্তর শুরু হয়ে যাচ্ছে৷ কারণ, এখান থেকে গঙ্গার নানান শাখানদী বের হতে থাকে ও এইভাবে সংক্ষিপ্ত পথে এগুলি সাগরে গিয়ে মিলিত হয়৷ ওদিকে ব্রহ্মপুত্র নদী  তার সঙ্গে বয়ে আনে তিব্বত–চীন সভ্যতা৷ আর এই ব্রহ্মপুত্র বাহিত সভ্যতা চূড়ান্ত রূপ নেয় বাঙলায় এসে৷ মানব সভ্যতার আদি পীঠস্থান যে ‘পশ্চিম রাঢ়’ সেখানকার সভ্যতাও রােের বিভিন্ন নদীবাহিত হয়ে গাঙ্গেয় সভ্যতার সঙ্গে মিশে সভ্যতার আরও উৎকর্ষ সাধন করেছে৷ তাই বাঙলার সভ্যতা রাঢ়ীয় সভ্যতা, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সভ্যতা ও মঙ্গোলীয় (চীন–তিব্বতীয়) সভ্যতার মিলনে সৃষ্ট এক অতি উন্নত বিমিশ্র সভ্যতা৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের ভাষায়, বাঙলায় তিনটে ব–দ্বীপীয় সভ্যতার বিমিশ্রণ ঘটেছে–গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা ও রাঢ় সভ্যতা৷ জগতের সভ্যতার ইতিহাসে এটাই সর্বোত্তম বিমিশ্র সভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷

তাই বাঙলার সভ্যতা অতি উন্নত সভ্যতা৷ চৈতন্যদেব, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ বাঙালী জাতির ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন৷ বাঙলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও তার পরিণতিতে বাঙালীদের মুক্তিসংগ্রামের স্বীকৃতি জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘ ‘বাংলা ভাষা দিবস’কে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ওপার বাংলার বাঙালী তরুণ প্রজন্ম বাঙালী জাতীয়তা বিরোধী ইসলামী মৌলবাদের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রাম করে চলেছে৷

এই পরিস্থিতিতে সমস্ত আলস্য ও আত্মস্বার্থের কূপমণ্ডুকতা ত্যাগ করে পরানুকরণ ত্যাগ করে বাঙালী জাতিকে আত্মসচেতন হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সার্বিক আত্মবিকাশের পথ  ধরে দ্রুত পদবিক্ষেপে এগিয়ে চলতে হবে৷

বিশ্বসভ্যতার ভাণ্ডারে বাংলার অনেক কিছু দেওয়ার আছে৷ আজ সারা পৃথিবী জুড়ে যে সার্বিক অবক্ষয়ের অধোগামী স্রোত দেখা দিয়েছে, এই উন্মার্গগামী প্রবণতাকে রোধ করে বিশ্বমানবতা তথা বিশ্বজুড়ে মানবতার প্রতিষ্ঠাকল্পে বাঙালীকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে৷ বাঙলার সমুন্নত সভ্যতা–সংসৃক্তির মধ্যে সেই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা রয়েছে৷

বর্তমানে এটা বাস্তব সত্য যে, বাংলা ও বাঙালী আজ শোষিত৷ ভাষাগত ভাবে, সংসৃক্তিগত ভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে সব দিক থেকে বাঙলার ওপর বর্তমানে অবদমন চলছে৷ অর্থনৈতিক শোষণ বাঙালীর মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে৷ বাঙলার অর্থনীতি, শিল্প–কারখানা–ব্যব এখন একশ্রেণীর অবাঙালী পুঁজিপতিদের কুক্ষীগত৷ বাঙলাকে শোষণ করে তারা একে ছিবড়েতে পরিণত করে দিচ্ছে৷ বাঙলার কৃষিজাত কাঁচামাল বাঙলার বাইরে চলে যাচ্ছে৷ বাঙলা থেকে অর্থেরও বহিঃস্রোত সমানে চলেছে৷ তাই দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার জগদ্দল পাষাণের তলায় বাঙলার মানুষ আজ নিষ্পেষিত, দলে দলে বাঙলার তরুণ–যুব সমাজ আজ অন্ন সংস্থানের জন্যে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে৷ বাঙলার অর্থনীতি চরম ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে৷ এই বাঙলার অর্থনীতিকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করতে গেলে ও সমৃদ্ধ করতে গেলে প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি ও সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল তত্ত্ব ও তার বাস্তব রূপায়ণ চাই৷

আজ তাই শুয়ে বসে নিরুদ্বিগ্ণ চিত্তে কালক্ষয় না করে নোতুন ভাবে বাঙলা গঠনের আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷

 

আদর্শহীন রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্রের নাম ভাঙ্গিয়ে গণতন্ত্রকে ধবংস করার নেশায় মেতে উঠেছে

অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে যতদিন যাচ্ছে এদেশে দলীয় সরকারগুলি দলবাজি যতটা করছে তার চেয়ে দেশের সামাজিক  ও আর্থিক উন্নতির  কাজ যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেদিকে তিলমাত্র নজর দিচ্ছে না৷  ফলে চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বেকার  সমস্যা  দেশের নাভিশ্বাস উঠছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রেও নেমে এসেছে একটা অনিশ্চয়তা ও হতাশা৷  তারই দরুণ শিক্ষা জগতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে৷ প্রশ্ণপত্র ফাঁস থেকে এমন সব কাণ্ড ঘটছে  যা খুবই  লজ্জাজনক৷ অভিভাবকগণ ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে বর্ত্তমানে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়তে নজর দিচ্ছেন৷  কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে রুজি-রোজগারের তেমন সুযোগ না থাকায় ইঞ্জিরিয়ারিং পড়ার দিকে  অনীহা দেখা দিয়েছে তাঁদের মনে৷  প্রায় ২০০টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে নাকি ছাত্র ছাত্রা ভর্ত্তি হয়নি৷  যারা  শিক্ষালাভ করছেন তাঁরা দেশে রুজি-রোজগারের সুযোগ নেই বলে বিদেশে গাড়ি দিচ্ছেন৷ এটা  অশুভ লক্ষণ৷ এতে দেশের বৌদ্ধিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে৷ অন্যদিকে  এদেশের কল-কারখানা সম্প্রসারন না হয়ে তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ বেকারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে৷ তা হলে  দেশের উন্নতিটা কী হচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলো কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডার ধরার কাজে উঠে পড়ে লেগেছে৷ তারা অনেকে পড়াশুনার শেষে সরাসরি দলে যোগ দিয়ে দলের মধ্যে  নানা ধরণের  বিরোধিতা করছে ও অশান্তি পাকাচ্ছে৷  বিশেষ করে এই রাজ্যে রাজনৈতিক  প্রবণতাটা রাজ্যের  যুবক যুবতী তরুণ তরুণীদের অন্য রাজ্যের চেয়ে বেশী৷

 ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক দুর্নীতিটা  যতদিন  যাচ্ছে এই রাজ্যই বেশী করে বাড়ছে৷ রাজনৈতিক মানটাও কমছে, আর দল থেকে অনেকেই  নেতা নেত্রীদের লাগাম ছাড়া হচ্ছে৷ রাজ্যটা ধীরে ধীরে অশান্তি ও অরাজকতার দিকে এগিয়ে চলেছে৷ বেকারত্বের এটা যে  একটা কারণ সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷  অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যখন যে শাসনে আসে, তখনই সেই দলে জনসমর্থন  লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে , কারণটা একটাই  কিছু  পাবার  আশায়৷ তাই যে দল শাসনক্ষমতা হারায় তাদের আর খঁুজে পাওয়া যায় না৷  তাদের চরম দুর্দশা নেমে আসে ৷ সংবাদ পত্রে দেখা যায় দলে দলে লোক যোগ দিচ্ছে শাসকদলের দিকে৷ আবার যে দল মাথাচাড়া দিচ্ছে সে দলে কিছু পাবার  আশায় লোক অন্যদল ভেঙ্গে ঢুকছে, মার খাচ্ছে৷ ধুনী জ্বেলে  বসে আছে বয়স্করা৷ এটাই হলো এক করুণ দলীয় দলনীতির ছবি৷ এটা কিন্তু  প্রকৃতপক্ষে  দেশের সামগ্রিক সামাজিক চেহারা ৷   আর্থিক  লক্ষ্য নেই,  তাদের নজরটা শুধু গদি রক্ষার দিকে৷ তারা মুখে উন্নতির বাণী ছড়ায় ৷ আর ঋণভারে দেশ আর্থিক উন্নয়ন  রুদ্ধ করেই ছাড়ে৷ ভারতের  যে বাৎসরিক আয় হয়, তার কয়েকগুণ বেশী খরচ হয় দেশের প্রশাসনিক খরচ চালাতে৷ তাই বহুদলীয়  গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাটা এদেশে  এক মর্র্মন্তিক আর্থিক, সামাজিক ব্যর্থতাকে বাড়িয়ে তুলেছে৷ মানুষের শুভ গুণগুলিকে এইসব নেতা ও নেত্রীগণ দলীয় স্বার্থে ধবংস করেই ছাড়ছে৷ অভিজ্ঞতায় দেখা গেল কোন রাজনৈতিক দল ৭০ বছরে  দাঁড়াতে পারলো না টুকরো টুকরো  হয়ে ছোট ছোট দলে পরিণত হলো৷

এখন রাজনৈতিক দলগুলির একমাত্র  লক্ষ্য হয়ে উঠেছে যেন তেন প্রকারেণ গদি দখল৷  তাই নির্র্বচনী  বৈতরণী পার  হওয়ার জন্যে প্রায় সমস্ত  বড় বড় দলগুলিই প্রতিপক্ষের  ওপর  ঝাঁপিয়ে পড়ছে  নানান্ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে৷

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্র্বচনে  তাই দেখা যাচ্ছে প্রায় সব জেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে৷ প্রতিপক্ষের  প্রার্থী মনোনয়ণপত্রই পেশ  করতে দিচ্ছে না চলছে মারপিট, খুন-জখম, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসসৃষ্টির  পরিস্থিতি৷  যাদের যেখানে বেশী ক্ষমতা তারা সেখানে উগ্রভাবে  ক্ষমতা প্রদর্শনে  মেতে উঠেছে৷ তাকে  আর যাই হোক গণতন্ত্র বলা যায় না৷ গণতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে গদি দখলের  লড়াই৷