মুসলমান সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই প্রথা প্রচলিত ছিল ঃ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে বনিবনা না হলে পুরুষ তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যেত৷ এখানে স্ত্রীর কোনো কিছু বলবার অধিকার ছিল না৷ এমনকি, কিছুক্ষণ পরে স্বামীও যদি মনে করত, তার এটা করা ঠিক হয়নি, তাহলেও তাকে এই বিবাহ বিচ্ছেদ মেনে চলতে বাধ্য হতে হত৷ এর পরে বহু মুসলীম নারীর জীবনে নেমে আসত দুর্বিসহ অন্ধকার৷ ছেলেমেয়েদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়তে হ’ত তাদের৷ এমনকি প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ পাওয়ার কোনো অধিকার থাকত না৷
নারী জাতির পক্ষে এই চরম অবমাননাকর ও দুঃখকর তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে ভারতের শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছে৷ এই তিন তালাক প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে৷
ডগ্মা মানব জাতির পক্ষে এক বিরাট শত্রু৷ ডগ্মা হলো অযৌক্তিক বিশ্বাস৷ ডগ্মা কি? ডগ্মা হলো জনসাধারণের মনে এক গণ্ডী বেঁধে দেওয়া হয়, এর বাইরে যাওয়া চলবে না, এ ব্যাপারে কোনো যুক্তি দেওয়া চলবে না, এটা মানতেই হবে৷ মানুষও ভয়ে এইটাকে মেনে চলে৷ প্রাউট সমস্ত প্রকার ডগ্মার বিরোধী৷ প্রাউট বলে, মানুষকে যুক্তি-বিবেকের পথ ধরে চলতে হবে৷ সমস্ত ডগ্মার প্রাচীর ভেঙ্গে এগোতে হবে৷
ইসলাম ধর্মের প্রায় গোঁড়ার দিক থেকেই নাকি ‘তিন তালাক’ প্রথা চলছে৷ বলা হচ্ছে, পুরুষ যদি এক নিঃশ্বাসে তিনবার ‘তালাক’ বলে বসে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল৷ কারুর কিছু বলবার বা করবার নেই৷
গত ১৪০০ বছর ধরে মুসলিম সমাজে এই অমানবিক প্রথা চলে আসছে৷ মুসলিম সমাজের মধ্যেও যারা বিবেকবান্ তাদের বহু আন্দোলনের ফলে কিছু দেশে এই অযৌক্তিক, অমানবিক ‘তিন তালাক’ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হয়েছে৷ কিন্তু ভারতের মত তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রে এতদিন এই প্রথা বহাল তবিয়তে চলছিল৷
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের সায়রা বাণু ও পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া জেলার ইশরত জাহান, আমেদাবাদের আফ্রিণ রহমান, গুশশান পারভিন ও উত্তরপ্রদেশের আতারি সাবরি ‘তিন তালাক’ প্রথার চরম শিকার হয়ে সুপ্রিম কোর্টে এই চরম অমানবিক ‘তিন তালাক’ প্রথা নিষিদ্ধ করার জন্যে আবেদন করেছিলেন৷
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গত ২২শে আগষ্ট প্রধান বিচারপতি খেহরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায়ে এই ‘তিন তালাক’ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন৷ সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি৷ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির মধ্যে প্রধান বিচারপতি জে. এস. কেহর ও বিচারপতি এস. আব্দুল নাজির সরাসরি এই ‘তিন তালাক’ প্রথা নিষিদ্ধ করতে চাননি৷ কিন্তু অপর তিনজন বিচারপতি---কুরিয়েন জোশেফ, বিচারপতি রহিস্তন ফলি নরিম্যান ও বিচারপতি ইউ. ইউ. ললিত স্পষ্ট ভাষায় এই ‘তিন তালাক’ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন৷ তাই পাঁচজন বিচারপতির মধ্যে তিনজন বিচারপতির ‘তিন তালাক’ প্রথার নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করায় সংখ্যাধিক্যের রায়েই ‘তিন তালাক’ প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে গেল৷ শীর্ষ আদালতের রায়ে বলা হয়, আগামী ছয় মাস ‘তিন তালাক’ দিলে কোনো বিবাহ বিচ্ছেদ হবে না৷ ছয় মাসের মধ্যে সরকারকে এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করতে হবে৷ এই সময়ের মধ্যে সরকার আইন প্রণয়ন না করলেও ‘তিন তালাক’ প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে৷
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম নারীরা খুশী৷ তবে কেবল মুসলিম নারীদের পক্ষে নয়, নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই রায় একটা বড় পদক্ষেপ৷
বর্তমানে প্রায় সব দেশেই নারী জাতিকে কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো গণ্য করা হয়৷ নিপীড়িত মানবতার মুক্তিমন্ত্র ‘প্রাউট’-এর উদগাতা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘মানব ইতিহাসে দেখেছি, নারীরা কেবল নারীত্বকে গৌরবান্বিত করেনি, সমস্ত মানব জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে---কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই৷ জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানেই হোক বা সামাজিক শিক্ষা, নৈতিক সংস্কারই হোক---সর্বক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষের মতই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷
কিন্তু ইতিহাসের ধারাপ্রবাহে আমরা দেখেছি সারা পৃথিবী জুড়ে নারীদের ওপর শোষণের মর্মান্তিক চিত্র৷ আজও পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর স্থান প্রায় দাসীর মতই---এটাকে কেবল মন্দই নয়, এটা নিন্দনীয়ও৷ নারীদের ওপর এই ধরণের অবদমন ও ভাবজড়তার সাহায্যে তাদের ওপর মানস-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো উচিত৷
- Log in to post comments