মানুষ শুধুমাত্র তার জ্ঞান, ৰুদ্ধি অথবা সামাজিক মর্যাদা দিয়ে একটা মহান আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না৷ একমাত্র নিজের আচরণের মাধ্যমেই সে এটা করতে পারে৷ আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারাই মানুষের আচরণের পরিশুদ্ধতা আসে৷ এর জন্যে তার তথাকথিত উঁচু বংশে জন্মগ্রহণ করার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেবার দরকার নেই৷ এতে বরং তার মনে একটা মিথ্যা অহংৰোধ তৈরী হতে পারে যা শেষপর্যন্ত তার আচরণের পরিশীলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে৷
আমাদের এই বিশ্বে দু’টো শক্তি পাশাপাশি সক্রিয় রয়েছে–একটা সাত্ত্বিকী ও আরেকটি তামসিকী৷ কখনও সাত্ত্বিকী শক্তি প্রবল হয় আবার কখনও তামসিকী শক্তি প্রবল হয়৷ এদের মধ্যে কোনোদিন কোনো সমঝোতা হবার জো নেই৷ এই বিপরীত শক্তি দু’টির অন্তহীন সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই মানুষকে সামনের দিকে চলতে হবে৷ এই সমাজে একদিকে আমরা দেখছি সমাজদ্রোহীদের হাতে সঞ্চিত বিপুল ধনসম্পদ আর অন্যদিকে লক্ষ্য করছি নীতিবাদীদের মধ্যে জমে থাকা এক গভীর হতাশা৷ কাজেই এই সব নীতিবাদীদের মধ্যে সংসার ত্যাগ করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে৷ ধনসম্পদ ও প্রতিপত্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি করে সমাজদ্রোহীরা বুক ফুলিয়ে আছে আর নীতিবাদীদের মনে হচ্ছে তারা যেন মস্ত অপরাধী৷ এই অবস্থাটা বাঞ্ছনীয় নয় আর শোভনীয়ও নয়৷ এটা আর চলতে দেওয়া যায় না৷
তোমাদের কর্ত্তব্য হবে সমস্ত নীতিবাদীদের ঐক্যৰদ্ধ করা৷ গড়ে উঠুক দু’টো শিবির৷ সামনাসামনি একটা লড়াই হয়ে যাক৷ নীতিবাদীরা এতদিন ছড়িয়ে থাকার ফলে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারেনি৷ পাঁচজন নীতিবাদীর ঐক্যৰদ্ধ শক্তি একশ’ জন নীতিবর্জিত ব্যষ্টির শক্তির চাইতে অনেক বেশী কারণ নীতিবর্জিত ব্যষ্টিদের জোট হয় অসাধু উদ্দেশ্যে৷ দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে শুধু সাধনায় মগ্ণ হলে চলবে না৷ আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে শক্তি সংগ্রহ করো ও নীতিবর্জিত মানুষদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংঘৰদ্ধ করো৷
সুতরাং তোমাদের ত্রিস্তরীয় কর্ত্তব্য রয়েছে–প্রথম কর্ত্তব্যটি হচ্ছে নৈতিকতা পালন করা ও আধ্যাত্মিক সাধনা করা৷ এটা না করলে মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করতে পারবে না৷ তোমাদের পরবর্ত্তী কর্ত্তব্য হচ্ছে বিশ্বের সমস্ত নীতিবাদীদের ঐক্যৰদ্ধ করা, না হলে ধর্ম স্থায়ী হবে না৷ শোষিত জনসাধারণ যারা নৈতিকতার মূল বিধি ‘যম–নিয়ম’ মানে না তারা তাদের অন্তরের হতাশার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে না৷ সেইজন্যে সমস্ত নীতিবাদীদের সংঘৰদ্ধ করার প্রয়োজন আছে৷ এটাই হবে তোমাদের প্রকৃত ধর্ম৷ এটা করলে তোমরা মহান হয়ে উঠবে কারণ ৰৃহতের ভাবনাই মানুষকে ৰৃহৎ করে তোলে৷ তৃতীয় স্তরে পৃথিবীর যেখানেই পাপশক্তি শিকড় গেড়ে বসেছে সেখানেই তোমাদের ক্ষমাহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷
ঘরে ঘরে তোমাদের এই আদর্শ সম্প্রচার করতে হবে৷ কোনো রাজনৈতিক দল অথবা তথাকথিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মানুষের মুক্তি আনতে পারবে না৷ শুধু খোল করতাল বাজিয়ে ভগবানের নাম কীর্ত্তনে সমাজের মুক্তি আসবে না কারণ এতে পাপীরা বশীভূত হয় না৷ পাপশক্তির তাণ্ডবলীলা স্তব্ধ করতে খোল করতালের চাইতে অস্ত্রেরই প্রয়োজন বেশী৷
মনে সামান্যতম দুর্বলতা থাকলেও পাপশক্তির বিরুদ্ধে বেশীদিন সংগ্রাম করা যায় না৷ এই সংগ্রামে পাপ অথবা পাপীরা কিন্তু তোমাদের মূল লক্ষ্য নয়, তোমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছেন পরম চৈতন্য সত্তা৷ চলার পথে যেসব বাধা আসবে তাদের নির্মমভাবে সরিয়ে দিতে হবে৷ মেঘ যখন ধ্রুবতারার চারপাশে জড় হয়ে তাকে ঢ়েকে ফেলে তখন তোমাদের কর্ত্তব্য হবে সেই মেঘকে সরিয়ে দেওয়া, ও মেঘ কোথায় গেল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ধ্রুবতারার পানে এগিয়ে চলা৷ যদি তুমি সর্বদাই শত্রুর কথা চিন্তা কর তাহলে তোমাদের মনে তোমাদের সেই ধ্যেয় বস্তুর খারাপ গুণাবলী এসে যাবে৷ কিন্তু যদি পরমপুরুষ তোমাদের লক্ষ্যবস্তু হন তাহলে তোমাদের মন পরমপুরুষেই রূপান্তরিত হয়ে যাবে৷
মনে রাখবে–তোমাদের মানবতার সেবা করতে হবে৷ সমগ্র মানবজাতির স্বার্থে তোমাকে আত্মোৎসর্গ করতে হবে৷ তোমাদের জীবন মূল্যবান, তোমাদের সময় আরও মূল্যবান৷ এক মুহূর্ত সময় তোমাদের নষ্ট করা চলবে না৷ তোমাদের কর্ত্তব্যকর্ম গৌরবময়৷ তোমাদের কর্ত্তব্যকর্ম অভিনব৷ যোদ্ধার জীবনযাপন করো আর অশুভশক্তির বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাও৷ জয়ী তোমরা হবেই হবে৷ তাই এগিয়ে চল, এগিয়ে চল৷
ডিসেম্বর, ১৯৬৬