ত্রিপুরার কিছু কথা ও তার অতীত ও বর্ত্তমান পরিস্থিতি

লেখক
প্রভাত খাঁ

ত্রিপুুরার নাগরিকপঞ্জীর দাবীতে ত্রিপুরা পিপলস্ ফ্রন্ট’ সুপ্রিম কোর্টে দাবী জানিয়েছে৷ অসমের এন.আর.সি নিয়ে আগেই সুপ্রিমকোর্টে মামলা চলছে৷

কিন্তু ত্রিপুরার বর্ত্তমান মুখ্যমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন ত্রিপুরায় এন.আর.সির দরকার নেই৷ সুপ্রিম কোর্ট আগামী ২৩শে অক্টোবর শুনানী হবার কথা ঘোষণা করেছেন৷ ত্রিপুরা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা এই প্রতিবেদনে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলেই মনে হয়৷ ত্রিপুরা রাজ্য গঠিত হয় ২১শে জানুয়ারী ১৯৭২ সালে৷ আয়তন ১০,৪৯১,৬৯ বর্গ মাইল৷ রাজধানী আগরতলা, লোকসংখ্যা, ৩৬,৭১,০৩২ বর্ত্তমানে কিছু বাড়তে পারে৷ রাজ্যপাল তথাগত রায়৷ এটি ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্য৷ এর নাম কেউ বলে থাকে ত্রিপুরার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী থেকে এসেছে৷ কেউ কেউ বলেন ‘‘তুইপ্রা’’ থেকে ত্রিপুরা নামকরণ হয়েছে৷ তুইপ্রা-এর জলের নিকটবর্তী স্থান৷ এক সময় এর বিস্তৃতি ছিল বঙ্গোপসাগরের তীর পর্যন্ত৷ ত্রিপুরা প্রায় সকল দিক বাংলাদেশের সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত৷ অসম ও মিজোরামের সংকীর্ণ সীমান্ত ছাড়া৷ রাজ্যটি পাহাড়, উপত্যকা, সমতল ভূমি নিয়ে ঘটিত৷ গোমতী নদীটি ২৫৮ কিমি৷ এটি ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে৷ এটি ১৭৬ কিমি ত্রিপুরায় রয়ে গেছে৷ রাজমালার তথ্য অনুযায়ী চন্দ্র বংশীয় যথাতিপুত্র দ্রহু কিরাত দেশে ত্রিবেগন্দমে রাজ্য ও নোতুন রাজ্যবংশের প্রতিষ্ঠা করেন৷ এদের উত্তরসুরি রত্নফা গৌড়ের রাজা রুকনুদ্দিন বারবকশা (১৪৫৫-৭৬)-এর সহায়তা ত্রিপুরা জয় করেন৷ গৌড়েশ্বর রত্নফাকে মানিক্য উপাধি দেন৷ রত্ন হন রত্নমানিক্য৷ ফা অংশটি বাদ যায়৷ তবে একটি তাম্র শাসন থেকে রত্ন মানিক্যের আগে রাজা ধর্ণমানিক্যের বিবরণ পাওয়া যায়৷ তাঁর কিন্তু রাজত্ব কাল ছিল (১৪৩১-১৪৬২) সাল (রাজমালা)৷ রাজ ধর্ণমাণিক্য মুসলমানদের হাত থেকে ত্রিপুরার বেশ কিছু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে৷ এখন প্রশ্ণ ধর্ণই যে রত্ন তা অস্বীকার করা যায় না৷ তবে রাজা রত্ন মাণিক্যের আমলে বাংলার সঙ্গে ত্রিপুরার ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ হয়৷ তাঁর আমলে প্রায় ১০,০০০ বাঙালী ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাস শুরু করে ৷ তখনকার দিনে প্রজা সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে রাজারা তাদের সুযোগ সুবিধা দিতেন রাজ্যের সর্বাঙ্গীন কল্যাণে৷ আবার দেখা যায় ধর্ণ নয় ধন্যমানিক্য নামে (১৪৯০-১৫২০) গৌড়ের রাজা হুশেন শাহের কাছ থেকে চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করেন৷ তিনিই নাকি ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির ও কমলা সাগর নির্র্মন করেন৷

পরবর্ত্তীকালে উদয় মানিক্য তিনি রাজবংশে জন্মাননি৷ রাজমাতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন৷ তিনি উদয়পুর রাজধানীর নাম রাখেন রাঙামাটির নাম বদল করে৷ রাজা অমর মানিক্য (১৫৭৭-৮৬) উদয় মানিক্যের পুত্র জয় মানিক্যকে হত্যা করে পুরাতন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন৷

উল্লেখযোগ্য রাজা গোবিন্দ মানিক্য (১৬৬০-৭৬) ও তাঁর ভ্রাতা নক্ষত্র রায়ের মধ্যে বিরোধ রবীন্দ্রনাথ এই কাহিনী অবলম্বনে রাজর্ষি উপন্যাস ও বিসর্জন নাটক লেখেন৷

কৃষ্ণমাণিক্য (১৭৬০-৮৩) রাজত্বকালে ১৯৭১ সালে ইংরেজ ত্রিপুরার জয় করলে ও ১৮৭১ সাল পর্যন্ত কোন স্থায়ী প্রতিনিধি৷ (রিজেন্ট) ত্রিপুরায় পাঠায়নি৷ মনে রাখা দরকার এই সবই প্রায় আড়াই বছর আগের ঘটনা৷ তখন সাল বলতে যা বোঝায় সে সম্বন্ধে সাধারণের কোন জ্ঞানই ছিল না আর এ সবই যে বা যারা, মধ্যে অমিল রহে গেছে৷ তবে একটা ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি মাত্র৷ মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে এক স্থান থেকে বাঁচার কারণে হাজির হয়েছে৷ গৌরবঙ্গ হলো বিশাল বাঙালী অধ্যুষিত এলাকা আর ত্রিপুরা হলো সেই বাংলার বৃহত্তর বাংলার পূর্বের সীমান্ত এলাকা৷ আজও দেশের যে ভাগের ফলে পরিবর্ত্তন ঘটেছে তারই সীমানাজুড়ে৷ তাই দেশভাগের ফলে প্রাণের দায়ে অনেক অসহায় হিন্দু পরিবার সীমান্ত এলাকা ত্রিপুরার আশ্রয় নেয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জন্যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গার কারণে৷ এই কারণে নেহেরু লিয়াকৎ চুক্তি হয় সংখ্যা লঘুদের ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভারত তাদের গ্রহণ করবে৷ দুর্র্ভগ্যের বিষয় আবার পূর্ব পাকিস্তানে গণ অভ্যুত্থান ঘটে৷ তারজন্যে আবার হিন্দু যারা অসহায়তা প্রাণের দায়ে সীমান্ত এলাকা হিন্দুরাজ্য ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয় অমুসলমান পরিবার বিশেষ করে বাঙালীরা৷

স্মরণে থাকে যে ত্রিপুরা রাজারা বাংলাভাষার উন্নয়নে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে এসেছেন৷ এমনকি রাজারা সারা জীবন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের উন্নয়নকল্পে আর্থিক সাহায্যও দিয়ে এসেছেন একজন সার্থক রাজা হিসাবে৷ তারা বাংলা ও বাঙালীর কৃষ্টি সংস্কৃতির উন্নয়নে সার্থক কাজ করে এসেছেন৷ শুধু তাই নয় ত্রিপুরা এ ব্যাপারে ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জাজ্বল্যমান হয়ে আছে৷

রাজা কৃষ্ণ মানিক্যের আমলে ১৯৬১ সালে উদয়পুর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় পুরাতন আগরতলায়৷ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের আমলে (১৮৬২-৯৬) সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয়৷ রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্যের আমলে ( ১৯০৯-২৩) বাংলার নবজাগরণের ঢেউ এসে পড়ে ত্রিপুরায়৷ বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য ত্রিপুরার শেষ রাজা৷ তিনি ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে মারা যান৷ মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা দেবীর সভাপতিত্বে কাউন্সিল অব রিজেন্ট ঘটিত হয়৷ ১৯৪৭ সালের ৯ই সেপ্ঢেম্বর মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবী ভারতীয় ইউনিয়নে ত্রিপুরার যোগদান সম্পর্কিত দলিলে স্বাক্ষর করেন৷

ত্রিপুরা ভারতীয় প্রশাসনের অধীনে আসে ১৯৪৯ সালের ১৫ই অক্টোবর৷

১৯৫০ সালের ২৬শে জানুযারী সংবিধান মোতাবেক ত্রিপুরা ‘গ’ শ্রেণীর রাজ্যের মর্যাদা পায়৷

১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচন হয়৷ ৩০ সদস্যের একটি ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচিত, যার কাজ রাজ্যসভার জন্য ১ জন সদস্য নির্বাচন৷

১৯৫৩ সালে চীনা কমিশনারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে রাষ্ট্রপতি মনোনীত একটি উপদেষ্টা পরিষদ ঘটন হয়৷

১৯৫৬ সালের ১লা নবেম্বর ত্রিপুরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্য্যাদা পায়৷

১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচণে ৩০ সদস্যের ত্রিপুরা আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হয়৷ ১৯৫৯ সালের ১৫ই আগষ্ট আঞ্চলিক পরিষদের আইন অনুসারে পূর্বের ৩০ জন ও সরকার মনোনীত দুইজন সদস্য নিয়ে ত্রিপুরা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়৷ শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ পরিষদের চেয়ারম্যান হন৷

১৯৬২ সালে তৃতীয় সাধারণ নির্র্বচনে ২০ সদস্যের আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হয়৷ ১৯৬৩ সালের ২৪শে জুন অঞ্চলিক পরিষদের শেষ অধিবেশন৷ ১লা জুলাই আঞ্চলিক পরিষদ ত্রিপুরায় প্রথম বিধানসভায় রূপান্তরিত হয়৷ শচীন্দ্রলাল সিংহের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের মন্ত্রীসভা ঘটিত হয়৷

১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারী, চতুর্থ নির্বাচনে ৩০ সদস্যের দ্বিতীয় বিধানসভায় শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের মন্ত্রীসভা ঘটিত হয়৷

১৯৭১ সালে ৪ঠা নবেম্বর ত্রিপুরায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়৷ ১৯৭২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী ত্রিপুরা পূর্ণরাজ্যের মর্য্যাদা পায়৷ ২০শে মার্চ পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন হয়৷

 একে তো অতি ক্ষুদ্র রাজ্য এর উপর এখানে ১৯৮২, ৩রা জানুয়ারী ২৮ সদস্যযুক্ত উপজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদ এর নির্র্বচন হয়৷ ১৮ই জানুয়ারী উপজাতি স্বশাসিত অঞ্চল জেলা পরিষদ ঘটিত হয়৷

১৯৮৫, ৩০ শে জুন, ষষ্ঠ তপশিল অনুযায়ী জেলা পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়৷ ১৯ শে জুলাই জেলা পরিষদের প্রথম অধিবেশন৷ এইসব কাজ সিপিএমের শাসনে হয়৷ ষষ্ট তপশিল -এর সুবিধা ভোগকরার বিরুদ্ধে মহামান্য আদালতে মামলা রুজু হয়৷ স্মর্ত্তব্য ১৯৯৪-এর ৫ই ফেব্রুয়ারী দীর্ঘ আট বছর বাদে চাকমা (শাক্যমা অর্থাৎ গোষ্ঠী) শরণার্থীদের ৭৭ টি পরিবার বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে যায়৷ মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় প্রভাত রঞ্জন সরকারের মতে চাকমা জাত বাঙালী৷ এরা শাক্য বংশোদ্ভুত যে বংশে তথাগত বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন৷ জনসংখ্যা রাজ্যের ৩১ শতাংশ মানুষই বাঙালী৷ এদের মাতৃভাষা বকবরফ, গ্রাম পঞ্চায়েত আছে ১১৮ টির মধ্যে ৫৯১ টি গ্রাম পঞ্চায়েত সর্বসাধারণের আর ত্রিপুরা স্বশাসিত উপজাতি এলাকার মধ্যে ৫২৭ টি৷

উপজাতিদের মধ্যে ত্রিপুরার সংখ্যা গরিষ্ঠ তার পরেই রিয়াং উপজাতি, আর আছে চাকমা উপজাতি৷ এরা বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক৷ চাকমাদের দৈনন্দিন জীবন অত্যন্ত পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন৷ এদের মধ্যে শিল্পীমনের মানসিকতা প্রবল৷

এখন যেটা নিয়ে বেশী সাধারণ জনগণ চিন্তিত তা হলো কালা কানুনের এন.আর.সি এর হুমকী৷ শতশত বছর ধরে ত্রিপুরার শান্তি প্রিয় সমতলি, পাহাড়ি মানুষরা বাস করে এসেছেন৷

তারা পরম আত্মীদের মত ছিল কিন্তু বছর ৬০/৭০ হলো উঠতি কিছু অতিবিপ্লবীরা ঘৃণা বিদ্বেষ, ছল-চাতুরী বিস্তার করে ও অতি লোভ দেখিয়ে হিংসাশ্রয়ী বাতাবরণ তৈরী করে এই এলাকাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে৷ যাদের উদ্দেশ্যে টা ব্যর্থ হতে বসেছে৷ এখানে যারা বসবাস করছে সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটানোটাই উদ্দেশ্যে৷ যাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে তারা যাবে কোথায়?

পূর্বপাকিস্তান থেকেই তো উদ্বাস্তু হয়ে বেশী লোক এসেছে৷ তার বয়স তো হলো প্রায় ৭১ বছর৷ সেদিন যারা জন্মেছেন তারাতো বৃদ্ধ৷ তাদের পৌত্র, প্রপৌত্র তরুণ৷ তারা কোথায় যাবে? এই বাড়াবাড়ি না করে মিলে মিশে থাকার ব্যবস্থা করাটাই সার্থকগণতন্ত্রের পরিচয়৷

এখন বাংলাদেশ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মাঝামাঝির পর বাংলাদেশ থেকে প্রাণের দায় যারা এসেছে তাদের এদেশে থাকার সময় তো হয়ে গেলো যদি একবছর কোন মানুষ কোনদেশে এক নাগাড়ে বাস করে ও সে যদি কোন দেশের নাগরিক বলে স্বীকার না করে, যে দেশে অবস্থান করছে সেই দেশের নাগরিক হতে চায় তাকে অবশ্যই সেই দেশ নাগরিকত্ব দান করাটাই কালাকানুন৷ মানবিকতা তাই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর তৈরী অসমের জন্যে কালাকানুন সেটা কোনভাবেই ভারতের অন্য কোন রাজ্যে প্রয়োগে করে সর্বনাশ না করাটাই কাম্য৷ এর কুফল মারাত্মক হতে বাধ্য৷

মনে রাখতে হবে ত্রিপুরাতো দু’টুকরো হয়েই গেছে৷ একেই ক্ষুদ্রতম রাজ্যে এরপর আবার একে রক্তাক্ত করার ষড়যন্ত্র কি কারণে?