ঊনিশে মে, বাংলা ভাষার দিন

লেখক
সুপ্রিয় ব্যানার্জি (হোয়াট্স্ এ্যাপ থেকে প্রাপ্ত)

১৬ বছরের জন্য সে এসেছিল মায়ের কোলে।

১৬ বছর বয়স, কৈশোর পেরিয়েছে বলা যায় না। এখনকার অত্যাধুনিক যুগের এক কিশোরী হলে তার স্বপ্নে থাকত উচ্চশিক্ষা আহ্বান। তারপর ভালো চাকরি, সুন্দর সংসার, খ্যাতি, যশ, মান.. আমেরিকা… বৃটেন… । কিন্তু সে সব কিছুই তার ছিল না। তার একমাত্র কারণ সে তার মাকে ভালবাসত। যে মা তাকে জন্ম দিয়েছেন সেই মায়ের মুখের ভাষাকে ভালবাসত। লাঞ্ছিতা মাতৃভাষার অশ্রু মোছানোর শপথ নিয়েছিল সে। মাতৃভাষা বাঙ্গলার জন্য প্রাণ দেওয়া, সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া কিশোরী কমলা ভট্টাচার্যের কথা বলছি। ১১ জন ভাষা সেনানীর অন্যতমা কমলা ভট্টাচার্য । কত জন বাঙ্গালী মনে রেখেছেন সেই ১১ জনকে? ২১শে ফেব্রুয়ারী নামক হুজুগে ভেসে যাওয়া বাঙ্গালীর কাছে কমলা, সুকোমল, শচীন্দ্ররা বড় অচেনা।

 ব্রিটিশ সরকার অসমের পতিত জমি দুর্ভিক্ষ পীড়িত কৃষকদের বিলি করতে শুরু করলে পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের ভূমিহীন মুসলমানরা ব্যাপক হারে অসমমুখী হতে শুরু করে। সেখানে জনবিন্যাসের পরিবর্তন শুরু হয়। ১৯০৩ সালে তৈরি হল বঙ্গভঙ্গের খসড়া। এই খসড়ায় পূর্ব বঙ্গের চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা, ময়মনসিংহকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে কার্জন গেলেন পূর্ব বঙ্গ, অতিথি হলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লার। সেখানে পরামর্শ হল পদ্মাপারে একটি ইসলামপ্রধান দেশ গঠন করা হবে । যার রাজধানী হবে ঢাকা।

 ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অসমে সাধারণ নির্বাচন হয় । এই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় লাভ করে কংগ্রেস কিন্তু সরকার গঠন করতে অস্বীকার করেন। এই পর অসমের গভর্নর মহম্মদ সইদুল্লা নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগকে মন্ত্রী সভা গঠনের জন্য ডাক দেন। ১৯৩৯ সালে এই সইদুল্লাই অসমের পতিত জমিতে বাঙ্গলাভাষী মুসলমানদের পুনর্বাসন দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেন।

১৯৪০ সালের লাহোর চুক্তিতে পাকিস্তান প্রস্তাবে আসামকেও পাকিস্তানের অংশ করে নেওয়াতর প্রস্তাব গৃহীত হয়। আসাম পাকিস্তানে গেলে সেখানের প্রাচীন ঐতিহ্য,কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম রক্ষা সম্ভব নয়। ফলে অসমিয়াদের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকল ইসলামিক আগ্রাসন নিয়ে আতঙ্ক ও ক্ষোভ। ইসলামিক ক্ষোভ ও আতঙ্ক থেকেই বাঙ্গলাভাষী মুসলিম বিদ্বেষ যা পরে বাঙ্গালী বিদ্বেষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

 ৬ এর দশকে রংপুরে অসমীয়া ভাষা শিখিয়ে আসামে মুসলিম অনুপ্রবেশ করা যাতে তারা নিজেদের আদি বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিতে পারে । নিজেদের অসমিয়া প্রতিপন্ন করতে বাংলাদেশি মুসলমানরা জনগণনায় নিজেদের মাতৃভাষা অসমীয়া উল্লেখ করতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকে দুর্বল করার জন্য বাঙ্গালী হিন্দু ও অসমীয়া হিন্দুদের মধ্যে নানা উপায় ঘৃণা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধানো হত। অসমের মাটিতে স্লোগান উঠতঃ

“মিঁয়া অসমিয়া ভাই ভাই,

বাঙ্গালীর (হিন্দু) ঠাঁই নাই

রক্ত চাই”।

১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়।

বরাক উপত্যকার বাঙ্গালী হিন্দুদের উপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল, ১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন।

১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।

বিকেল প্রায় ২:৩০র সময় ন’জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনো অসনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু’জন পরে মারা যান। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ বীরাত্মাদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।

বাঙ্গলা ভাষা রক্ষায় প্রাণ দেন

কানাইলাল নিয়োগী,  চন্ডীচরণ সূত্রধর,

হিতেশ বিশ্বাস,  সত্যেন্দ্রকুমার দেব,

কুমুদরঞ্জন দাস,  সুনীল সরকার,

তরণী দেবনাথ,  শচীন্দ্র চন্দ্র পাল,

বীরেন্দ্র সূত্রধর,  সুকোমল পুরকায়স্থ

এবং কমলা ভট্টাচার্য।

এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাঙ্গলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।