যোগ এক দিবসের জন্যে নয়, সমগ্র জীবনের সুদৃঢ় ভিত্তি

লেখক
মোহন সরকার

(দ্বিতীয় পর্ব)

‘যোগ’ হচ্ছে কী? না---জীবন গড়ার সাধনা, আত্মবিকাশের সাধনা৷ ‘একটা কলি অর্থাৎ কুঁড়ি থেকে ফুলের বিকাশ ঘটে, ওই কুঁড়ির মধ্যে যে রূপ, বর্ণ, গন্ধের সম্ভাবনা রয়েছে তা পরিস্ফুট হয়৷ একটা ছোট্ট বটবৃক্ষের বীজের মধ্যে একটা বিশাল বটবৃক্ষের সম্ভাবনা থাকে৷ তেমনি মানুষের মধ্যে অনন্ত শক্তি ও গুণের সম্ভাবনা রয়েছে৷ যথাযথ পরিচর্যার দ্বারা এই শক্তি ও গুণগুলির প্রকাশ ঘটাতে হয়৷

মানুষের তিনটি দেহ রয়েছে---শরীর, মন ও আত্মা৷ শরীর স্থূল দেহ, মন সূক্ষ্ম দেহ, আর আত্মা অতি সূক্ষ্ম বা কারণ দেহ৷ মানুষের জীবনের সুষ্ঠু ও পূর্ণ বিকাশ মানে হ’ল---শরীর, মন ও আত্মার সুষ্ঠু বিকাশ৷ আমাদের শরীরকে সুস্থ, নিরোগ করে তুলতে হবে৷ শরীরের মাধ্যমে মন কাজ করে, মনই হ’ল সকল কাজের প্রকৃত কর্তা৷ শরীরটা হ’ল মনের প্রকাশের মাধ্যম৷ একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে৷ একজন সৈনিক লড়াই করছে৷ মন হচ্ছে সেই সৈনিক, আর শরীর হ’ল বন্দুক৷ মনরূপী সৈনিককে যেমন সাহসী, বুদ্ধিমান ও তৎপর হতে হবে, তেমনি শরীর রূপী বন্দুক যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলেও চলবে না৷

উপনিষদে একটা উদাহরণ রয়েছে আমাদের শরীররূপী রথে আসীন রথী হ’ল আত্মা৷ আত্মাই যাত্রী, শরীরটা হ’ল তার রথ৷ এই রথের সারথী বুদ্ধি৷ ইন্দ্রিয়গুলো হ’ল ঘোড়া৷ মনঃশক্তি হ’ল লাগাম৷ এই রথের রথী আত্মা তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে যদি রথের সারথী অর্থাৎ বুদ্ধি মনঃশক্তিরূপ লাগামের সাহায্যে ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়াগুলিকে ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে রথটিকে সৎপথে পরিচালিত করে৷

পূর্বেই বলেছি মনই সকল কাজের কর্তা৷ মন ভালো পথে চললে একজন মানুষ ভাল হতে পারে, আবার মন খারাপ পথে চললে একজন খারাপ মানুষ হতে পারে৷ মনেই মানুষ দেবতা হতে পারে, আবার মনেই মানুষ শয়তান হতে পারে৷ মনে ভাল চিন্তাধারা আছে, আবার মন্দ চিন্তাধারাও আছে৷ মনের বিভিন্ন চিন্তাধারাকে বলা হয় বৃত্তি৷ মনের সু-বৃত্তি যেমন আছে কু-বৃত্তি বা কু-প্রবৃত্তিও আছে৷ যোগ বিজ্ঞানে বলা হচ্ছে, মনের মূল পঞ্চাশটি বৃত্তি৷ এগুলি হ’ল---ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, অবজ্ঞা, মুর্চ্ছা, প্রশ্রয়, অবিশ্বাস, সর্বনাশ, ক্রূরতা, লজ্জা, পিশুনতা, ঈর্ষা, সুসুপ্তি, বিষাদ, কষায়, তৃষ্ণা, মোহ, ঘৃণা, ভয়, আশা, চিন্তা, চেষ্টা, মমতা, দম্ভ, বিবেক, বিকলতা, অহঙ্কার, লোলতা, কপটতা, বিতর্ক, অনুতাপ, ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ, ওঁং, হুঁং, ফট্, বৌষট্, বষট্, স্বাহা, নমঃ, বিষ, অমৃত, অপরা, পরা৷ এদের মধ্যে কতগুলি ভাল, কতগুলি খারাপ, অর্থাৎ কতকগুলি মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে চলে, কতকগুলি বন্ধনের পথে নিয়ে যায়৷ তাই এগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ দরকার৷ আমাদের মেরুদণ্ডের ভেতরে রয়েছে সুষুম্নাকাণ্ড৷ মেরুদণ্ডের নিম্নতম বিন্দু থেকে শুরু করে সুষুম্নাকাণ্ড ও মস্তিষ্কের ঊধর্বতম বিন্দু (ব্রহ্মরন্ধ্র) পর্যন্ত কেন্দ্রীয় স্নায়ুমণ্ডলীর বিস্তার৷ এর মধ্যে রয়েছে প্রধান সাতটি চক্র---মুলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা ও সহস্রার৷ মূলাধার থেকে আজ্ঞা---এই ছয়টি চক্র থেকে উপরিউক্ত বৃত্তিগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়৷ এই চক্রগুলিতে রয়েছে বেশ কিছু গ্রন্থি৷ ওইসব গ্রন্থি থেকে রসবরণের (hormone secretion) মাধ্যমে বৃত্তিগুলির প্রকাশ ঘটে৷ এই গ্রন্থিগুলির যদি ত্রুটি থাকে তাহলে হর্মোণ ক্ষরণেও অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে, তাহলে সংশ্লিষ্ট বৃত্তিগুলিতেও অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে৷ যোগ সাধনার বিভিন্ন অঙ্গ ও উপাঙ্গগুলির দ্বারা যেমন যোগাসন, প্রাণায়াম, তত্তধারণা, চক্রশোধন প্রভৃতির দ্বারা  উপরি লিখিত চক্র সমূহের গ্রন্থিগুলির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন বৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়৷ এইভাবে খারাপ বৃত্তিগুলিতে সংযত করে ভাল বৃত্তিগুলিকে বাড়িয়ে তোলা যায়৷ আর মনের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মনের একাগ্রতা অর্জন করা যায়৷ সূর্যের আলোকরশ্মিকে যদি অতসী কাচের সাহায্যে কেন্দ্রীভূত করা হয় তাহলে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, ঠিক তেমনি মনের বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করে যোগাভ্যাসের সাহায্যে একাগ্র করা হয়, তাহলে মনের শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পায়৷ মনের একাগ্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও বৃদ্ধি পায়৷ চিন্তাশক্তিও বৃদ্ধি পায়৷

যোগাসনের মাধ্যমে বিভিন্ন চক্রের ওপর বাহ্যিক চাপ সৃষ্টি করা হয় ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন চক্রের তথা চক্রস্থিত গ্রন্থিসমূহের ত্রুটিও সারানো হয়৷ বিভিন্ন চক্রে মানসিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেও ওই চক্রকে নিয়ন্ত্রিত করা  হয়৷ যোগ সাধনার বিভিন্ন অঙ্গের সাহায্যে বিভিন্ন চক্রে আধ্যাত্মিক , স্পন্দন সৃষ্টি করে ও অশুভ বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে শুভ দিকে পরিচালিত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে৷

যোগাভ্যাসের মাধ্যমে মানসিক টেনশন ও স্ট্রেস থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়৷ যোগ-ধ্যানের সাহায্যে মন নির্মল ও শান্ত হয়ে যায়৷ মনে আসে গভীর শান্তি৷ অশুভ চিন্তা থেকে ফিরিয়ে এনে মনকে শুভ পথে পরিচালনার সর্বোৎকৃষ্ট পথ হ’ল যোগ সাধনা৷

যোগ সাধনার আধ্যাত্মিক দিকগুলি আগামী পর্বে আলোচনা করব৷