এক কথায় যোগ শরীর, মন ও আত্মার বিকাশের পথ৷ শরীরের বিকাশ মানে হ’ল শরীরের সমস্ত সম্ভাবনার সদব্যবহার করা, সোজা কথায় শরীরকে সর্বদা সুস্থ রাখা৷ যোগ মূলত আধ্যাত্মিক৷ যোগ মানে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগ, মনের সঙ্গে আত্মার সংযোগ৷ তাই যোগী বলতে গেলে তাঁদের বোঝায় যারা উচ্চতম আধ্যাত্মিক মার্গে রয়েছে, যাঁদের আত্মোপলব্ধি হয়েছে, তবে উচ্চ আধ্যাত্মিক মার্গে উঠতে গেলে শরীরটাকেও সুস্থ রাখতে হবে, তাই যোগ সাধনায় শরীরকে সুস্থ রাখার জন্যে বিভিন্ন যোগাসনের ব্যবস্থা রয়েছে৷ রোগ হলে তো ভালভাবে সাধনা করা সম্ভব নয়, তাই রোগ যাতে না হয় তার জন্যেই এই ব্যবস্থা৷ যেমন, নিয়মিত কিছু কিছু আসন অভ্যাস করলে ও নিয়মমতো চললে শরীর হঠাৎ করে রোগাক্রান্ত হবে না৷ প্যাংক্রিয়াস, লিভার, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড সহ শরীরের বিভিন্ন অত্যাবশক অঙ্গের নিয়মিত চর্চা করলে সেগুলি সবল থাকবে ও রোগমুক্ত থাকবে৷ রোগ হলেও যোগাসন অভ্যাস, কিছু কিছু গাছ-গাছড়া ব্যবহার করে যোগীরা নিজেদের শরীরকে সুস্থ করবেন ও যথারীতি যোগ ধ্যানে মন দিতেন৷
আমরা আজকাল সে সমস্ত ভুলে কেবল দামী দামী ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছি৷ ব্যয়বহুল অপারেশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি৷ কিন্তু আমরা যদি নিয়মিত আসন করি ও তার সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি জলপান বিধি, স্নানবিধি, উপবাসবিধি, স্বাত্ত্বিক আহার বিধি এ সমস্ত মেনে চলি, তাহলে আমরা নানান রোগের হাত থেকে মুক্ত থাকতে পারি৷ তাছাড়া, বিভিন্ন রাসায়নিক ওষুধের ব্যবহার তার পার্শ্ব পতিক্রিয়াও ডেকে আনে, সেদিক থেকে যোগাসন ও বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ থাকাটাই সর্বোত্তম৷ এই কারণে, যোগীশ্বর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আজকের যুগের মানুষের প্রয়োজন বুঝে তিনি ‘যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ’ পুস্তক রচনা করে, এই পুস্তকের মধ্যে বিভিন্ন রোগ, ওই রোগগুলির কারণ, এই রোগ নিরাময়ের জন্যে কী কী যোগাসন ও মুদ্রা অভ্যাস করতে হবে, তার সঙ্গে কী কী পথ্য গ্রহণ করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, কী ধরণের খাদ্য খেতে হবে, তার বিধান দিয়েছেন৷ তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন রোগের নিরাময়ের জন্যে কী কী খাদ্য অর্থাৎ ফল, শাকসব্জি, যুগপৎ ওষুধ ও পথ্যরূপে ব্যবহার করে সুস্থ হওয়া যাবে, তারও বিধান দিয়েছেন৷ তাঁর এই সমস্ত উপদেশাবলীও ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ পুস্তকে সংকলিত করা হয়েছে৷ আনন্দমার্গ প্রকাশন, ৫২৭ ভি.আই.পি. নগর, কলকাতা - ১০০---এই ঠিকানায় উক্ত পুস্তকাবলী পাওয়া যাবে৷ আনন্দমার্গের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করেও এই পুস্তকগুলি সংগ্রহ করা যাবে৷
আনন্দমার্গের চর্যাচর্য-তৃতীয় খণ্ডে বিভিন্ন আসন ও মুদ্রা কীভাবে করতে হবে তারও বিবরণ দেওয়া আছে৷
আসন অভ্যাসের জন্যে কিছু সাধারণ নিয়মও রয়েছে, তা না জেনে প্রায় মানুষকে আসন করতে দেখা যায়, তা ভালো নয়৷ ওই পুস্তকে আসনকারীদের জন্যে পালনীয় নিয়মাবলীরও উল্লেখ রয়েছে৷ যেমন, আসন করার সময় বাম নাকে শ্বাস রাখতে হয়, কম্বল বা মাদুদের ওপর আসন করতে হয়৷ যতদূর সম্ভব খালি গায়ে আসন অভ্যাস করা উচিত ইত্যাদি৷
তবে ওই পুস্তকে তিনি এও বলেছে, উপযুক্ত আচার্য বা আচার্যার সঙ্গে পরামর্শ না করে কেউ যেন ওই সমস্ত আসন-মুদ্রা অভ্যাস না করেন৷ কারণ, কার কী আসন বা মুদ্রা করা প্রয়োজন, কার কী আসন করা উচিত নয়, তাছাড়া বিভিন্ন আসন-মুদ্রার জন্যে কিছু নিয়ম-কানুন আছে, সে সব না জেনে আসন-মুদ্রা অভ্যাস করা ঠিক নয়৷ আনন্দমার্গের আচার্য-আচার্যারা বিনা পারিশ্রমিকে বা বিনাব্যায়ে সবাইকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে প্রস্তুত আছেন৷ কেবল আপনার দিক থেকে আগ্রহ থাকলেই হ’ল৷
প্রাণায়ামের ক্ষেত্রেও অনেক নিয়ম-কানুন আছে৷ তাই বই দেখে বা দূরদর্শনে দেখে প্রাণায়াম অভ্যাস করার ঝুঁকি যেন কেউ না নেয়৷ এতে হিতে-বিপরীত হবারই সম্ভাবনা৷
আসন-প্রাণায়ামের খাদ্যেরও বিধি আছে৷ আচার্য বা আচার্যার কাছে জানতে হবে৷ অনেক ধূমপায়ীকে দূরদর্শন দেখে প্রাণায়াম করতে দেখা যায়---তাতে শরীরের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবেই৷
মনের একাগ্রতার জন্যে, মনকে টেনশন মুক্ত করার জন্য ধ্যানাভ্যাসই বলা চলে একমাত্র উপায়৷ কিন্তু কীভাবে সেই ধ্যান করতে হবে তা কেবল পুস্তক থেকে পড়ে করা যাবে না, সে চেষ্টা করাও একেবারে ঠিক নয়৷
একটা অ্যালোপ্যাথি ওষুধের বই কিনে তা দেখে দেখে কেউ যদি দোকান থেকে ওষুধ ক্রয় করে খেতে থাকে তা যেমন ভীষণ ক্ষতিকারক ও একেবারে অনুচিত যোগ সাধনার ক্ষেত্রেও তেমনি আচার্য বা আচার্যার সহায়তা ছাড়া নিজে নিজে যোগ সাধনা করা অনুচিত৷ সবাইকার শারীরিক অবস্থা, মনের অবস্থা, মনের সংস্কার ভিন্ন ভিন্ন৷ এ সমস্ত বিচার করেই আচার্য-আচার্যারা এক-একজনকার জন্যে সাধনা পদ্ধতি স্থির করেন৷ শিক্ষক বা প্রশিক্ষক ছাড়া যেমন প্রকৃতপক্ষে কোনও বিদ্যা আয়ত্ব করাযায় না, যোগ সাধনার ক্ষেত্রে এটা ষোল আনা খাঁটি৷
সাধনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রের ব্যবহার আছে৷ অনেকে বলেন, মন্ত্রের আবার ব্যবহার কেন? মন্ত্রের আবার কী শক্তি? একবার এক স্বামীজীকে জনৈক বিদ্বান ব্যষ্টি এই কথাটাই বলেছিলেন---মন্ত্রের আবার কোনও শক্তি আছে নাকি? স্বামীজী তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘তুমি একটি ইডিয়েট’৷ সঙ্গে সঙ্গে ওই শিক্ষিত ভদ্রলোক রেগে লাল হয়ে গেলেন৷ রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বললেন, তুমি আমাকে ‘ইডিয়েট’ বলছ, তুমি জান আমি কে? স্বামীজী শান্ত অবস্থায় হেসে বললেন, ‘আপনি তো এতক্ষণ শান্ত ছিলেন, হঠাৎ এত ক্রুদ্ধ হয়ে কাঁপছেন কেন? ভদ্রলোক এই কথা শুণে আরো রেগে গেলেন৷ স্বামীজী বললেন, ‘দেখুন আমি আপনাকে একটি ছোট্ট শব্দ ‘ইডিয়েট’ বলাতে আপনার চেহারাতে ও মানসিক অবস্থাতে এত পরিবর্তন এসে গেল, তাহলে মানছেন তো, একটা শব্দের মধ্যে কত শক্তি লুকিয়ে থাকে? যা আপনার মধ্যে---এত পরিবর্তন এনে দিল৷ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও তেমনি কিছু কিছু শব্দ রয়েছে, যা আমাদের সত্ত্বার মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে৷ আমি কেবল আপনাকে হাতেনাতে এই জিনিসটা বোঝানোর জন্যে ‘ইডিয়েট’ শব্দটি ব্যবহার করলাম৷ কিছু মনে করবেন না৷ আপনাকে শুধু একথা বোঝাতে চাই , আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ শব্দের মধ্যে বিপুল ক্ষমতা রয়েছে৷
একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, যোগ সাধনার অভ্যাসের ক্ষেত্রে জাত-পাত-সম্প্রদায়গত কোনো ভেদাভেদ নেই৷ সেদিক থেকে যোগ মানব ধর্মের প্রতিভূ৷
- Log in to post comments