‘গজতা’ শব্দের অর্থ হ’ল হস্তীযূথ৷ তোমরা অনেকেই জান পৃথিবীর জীবসমূহ সমাজগতভাবে দু’টি ভাগে বিভক্ত –– এককচারী জীব ও যূথবদ্ধ জীব৷ যেমন ধর আমাদের অতি পরিচিত ছাগল, মুর্গী৷ এরা এককচারী জীব৷ নিজের স্বার্থেই ব্যস্ত..... একেবারেই self centered. এরা সাধারণতঃ একে অপরের কোন কাজে লাগে না৷ একে অপরের বিপদে ছুটে এসে রুখে দাঁড়ায় না৷ এরা প্রভুভক্ত বা নিষ্ঠাবান–ও (sincere) নয়৷ এরা প্রভুর দুঃখে তিলমাত্র বিচলিত হয় না৷ যেখানে থাকে .... থাকে নিজের স্বার্থে৷ কিন্তু ভেড়া যূথবদ্ধ জীব৷ দু’জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’টো ভেড়া ঘাস খাচ্ছে৷ একে অন্যকে দেখতে পেলে ছুটে তারা কাছে চলে আসে৷ পাশাপাশি থেকে ঘাস খেতে থাকবে৷ এক সঙ্গে থাকার দরুণ ভেড়ার পালের গতিকে বলা হয় ‘গড্ডালিকা–প্রবাহ’৷
‘‘ঐসী গতী সংসার কী সব গগার কী ঠাট্
এক জব্ গাা মে গীরে সব জাত তেহি বাট৷’’
পৃথিবীর মানুষের ধারা কতকটা এই রকমের একপাল ভেড়ার মত৷ একটা ভেড়া গর্ত্তে পড়লে বাকি সবাই সেই গর্ত্তেই পড়ে৷ মানুষও একটি যূথবদ্ধ জীব৷ বেশীদিন একলা থাকতে হলে সে ছট্ফট্ করতে থাকে৷ তার প্রাণ–মন মানুষের খোঁজে হাঁকুপাঁকু করে’৷ এজন্যে মানুষের সমাজে নেতা নির্বাচনে বড় বেশী সতর্ক হতে হয়৷ পৃথিবীর অনেক দেশের ইতিহাসে দেখা যায় দানব–স্বভাবের কোন কোন বুদ্ধিমান নেতা গোটা সমাজকে ধবংসের পথে ঠেলে দিয়েছে, অনেক জনগোষ্ঠী তাতে ধবংস হয়ে গেছে, অনেকে ধবংস হবার শেষ সীমায় এসে কোনক্রমে টাল সামলে নিয়েছে৷ কেউ কেউ personal cult বা ব্যষ্টিপূজার নিন্দায় পঞ্চমুখ৷ তাদের বোঝা উচিত যে personal cult বা ব্যষ্টিপূজা চলে এসেছে ও চলবেও৷ তাই বলছিলুম যে, নেতা নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে৷ এ ব্যাপারে কমিউনিষ্ট, ক্যাপিট্যালিষ্ট, সোস্যালিষ্টে কোন ভেদ নেই৷ সবাই এক রঙে রাঙা৷ নেতা চিনতে হবে তাঁর বিদ্বত্তা, বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়তা, অগ্রগামিতা, ত্যাগ স্বীকারে সদাপ্রাস্তুত্য ইত্যাদি গুণ দেখে৷ বাঘ যূথবদ্ধ জীব না হলেও সিংহ–হাতী যূথবদ্ধ জীব৷ হাতীর দলে অনেক সময় পঁচিশ–তিরিশ থেকে পঞ্চাশ–একশ’টা হাতীও থাকে৷ অল্পবুদ্ধি, ক্ষুদ্রমস্তিষ্ক্ আফ্রিকান হাতী যূথবদ্ধ, আবার তুলনামূলক বিচারে অধিকবুদ্ধি বৃহৎমস্তিষ্ক্ ভারতীয় প্রজাতির হাতিও যূথবদ্ধ৷ ভারতের পূর্ব প্রত্যন্তে
মধ্যমাকৃতির
পাংশুবর্ণ হাতী কিছুটা কম যূথবদ্ধ৷ তবে বিপদে–আপদে তারা সবাই একত্রিত হয়ে থাকে৷ এই এক একটি হস্তীযূথ বা একসঙ্গে থাকা প্রকাণ্ড একদল হাতীকে ‘গজতা’ বলা হয়৷ হাতী ধরবার জন্যে প্রাচীনকাল থেকে যে খেদা–ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তাও সাধারণতঃ হাতীর যূথবদ্ধতার কথা ভেবে৷
৬ মার্চ ১৯৮৮, কলিকাতা
(শব্দচয়নিকা পঞ্চদশ খণ্ড – প্রবচন ৩১৫)
***
‘গজেন্দ্র’ শব্দের একটি অর্থ হ’ল হাতীদের সর্দার৷ এর আগে অনেকবারই বলেছি হাতী যূথবদ্ধ জীব৷ যূথের দৃঢ়তা নির্ভর করে’ দৃঢ়চেতা নেতার ওপরে৷ অন্যথায় তার সংরচনা জীর্ণ–দীর্ণ হয়ে যায়......ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়৷ আকবরের দৃঢ়তায় মোগল সাম্রাজ্য ভারতে দৃঢ়তা প্রাপ্ত হয়েছিল৷ সমুদ্রগুপ্তের দৃঢ়তায় এককালে গুপ্ত সাম্রাজ্য হিমাচল থেকে গোদাবরী পর্যন্ত দৃঢ়নিবদ্ধ হয়েছিল৷ কিন্তু সেই দৃঢ়চেতা নেতার অভাব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মগধ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছল৷ আকবর গতায়ু হবার পর তাঁর অযোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতে পড়ে মোগল সাম্রাজ্য ছিন্নবিছিন্ন হয়ে গেছল, ও শেষ পর্যন্ত মারাঠা–শিখ শক্তির অভ্যুদয়ে, পাণিপথের শেষ যুদ্ধে তথা সীতাবলদীর যুদ্ধে মোগল সাম্রাজ্যের অস্থি–পঞ্জরও ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছল৷
বর্ত্তমানে মানুষ শাসনতন্ত্রের যে কয়টি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তাদের মধ্যে গণতন্ত্র তুলনামূলক বিচারে ভাল হলেও গণতান্ত্রিক সংরচনায় দৃঢ় নেতা পাওয়ার সুযোগ একনায়কত্ব শাসিত রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম৷ যার ফলে যুদ্ধ বিগ্রহেই হোক, বা সামাজিক–র্থনৈতিক মানোন্নয়নেই হোক, অথবা অন্য কোন ভৌমিক দৃঢ়ভিত্তিক অগ্রগতিতেই হোক, সবেতেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একটু দুর্বল হয়েই থাকে, যদিও একনায়কত্বর তুলনায় গণতন্ত্র অনেকটা দীর্ঘস্থায়ী হয়৷ তাতে খেয়াল–খুশীর তুলনায় যুক্তির স্থান কিছুটা বেশী থাকে৷ তা সত্ত্বেও একনায়কত্ব রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সংবদ্ধতা এনে দেয় গণতন্ত্র তা পারে না৷ হয়তো বা মানুষ ততটা চায়ওনা৷ একনায়কত্ববাদে ব্যষ্টির খেয়াল–খুশীতে অনেক সময় জনসাধারণকে হয়রান হতে হয়.......কিন্তু গণতন্ত্রে পার্টির খেয়াল–খুশীতে তথা পার্টির ক্যাডারদের তথা পার্টির চ্যালা–চামুণ্ডাদের অত্যাচারেও জেরবার হয়ে যেতে হয়......শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নেস্তনাবুদ হতে হয়৷ তোমরা ঠাণ্ডা মাথায় জিনিসটা ভেবে দেখ৷ ব্যষ্টি–একনায়কত্ব জিনিসটাকে যদিও সম্পূর্ণভাবে সমর্থন না করা যায় তাহলে পার্টি–একনায়ত্বকেই বা কোন যুক্তিতে সমর্থন করব৷ সে তো ব্যষ্টি–একনায়কত্বের্ চেয়েও আরেক কাঠি সরেস৷ অনেক সময় পার্টি–একনায়কত্বে অশিক্ষিত, অর্ধ–শিক্ষিত, অমার্জিত ক্যাডারদের উৎপাতে শিক্ষিত, মার্জিত রুচি মানুষদের ত্রাহি ত্রাহি করতে হয়৷ সেই রকম অবস্থায় পড়ে তারা অনেক সময় একনায়কত্বের অবসান চায়৷ কখনো কখনো বা বৈদেশিক রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়ে দমনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চায়, হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায়৷ জিনিসটা কঠোর হলেও সত্যি নয় কি? এই একনায়কত্ব, পার্টিএকনায়কত্ব ও গণতন্ত্রের টানাপোড়েনের একমাত্র সমাধান প্রাউটের সদ্বিপ্র–সূত্র৷
যাই হোক মোদ্দা কথায় ফিরে আসা যাক৷ হাতীর সমাজ দৃঢ়নিবদ্ধ .....দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ ৷ তাই প্রতিটি হস্তীযূথেই একটি করে’ উন্নত মানের সর্দার থাকে৷ ‘গজেন্দ্র’ মানে সেই হাতীর সর্দার৷
২৭ মার্চ ১৯৮৮, কলিকাতা
(শব্দচয়নিকা ষোড়শ খণ্ড প্রবচন –– ১১৮)