অগ্ণিযুগের বীর বিপ্লবী --- বাঘা যতীন

লেখক
দেবর্ষি দত্ত

নদীয়া জেলার একটি গ্রাম৷ সন্ধ্যার অন্ধকারে গ্রামের পথঘাট জনশূন্য হয়ে যায়৷ মনে হয় বুঝি শ্মশানের নিঝুমতা নেমে এসেছে৷ কিন্তু কেন? বিরাট এক রয়েল বেঙ্গল টাইগার গ্রামে হানা দিতে শুরু করেছে৷ বাঘটা ভীষণ হিংস্র৷ গরিব চাষিদের  গরু-বাছুর গোয়াল থেকে টেনে নিয়ে যায়৷ চাষিরা কান্নাকাটি শুরু করে দিল৷ কে তাদের বাঘের অত্যাচার থেকে বাঁচাবে? তখন ওই গ্রামে মামার বাড়িতে তার ছোটবেলার দিনগুলো কেটে ছিল৷ গ্রামের অনেকের সাথে সুন্দর সম্পর্ক৷ বিশেষ করে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষদের তিনি খুবই ভালোবাসেন৷ যতীন মুখার্জি ঠিক করলেন তিনি বাঘের সঙ্গে লড়াই করবেন৷ কিন্তু কি ভাবে? যতীনের কোন বন্দুক ছিল না৷ একটা ভোজালি দিয়ে বাঘের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত হলেন৷

অন্য কেউ এভাবে লড়াইতে অবতীর্ণ হলে গ্রামবাসিরা তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করত৷ কিন্তু সেদিনের তরুণ যতীনকে তারা ভালোভাবেই চিনত৷ তারা জানত, যতীন এর মধ্যে অসম্ভব সাহস আছে৷ দেহে আছি অদ্ভুত শক্তি৷ হৃদয় আছে প্রবল পরোপকার বৃত্তি৷ যতীনের এই অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় গ্রামবাসীরা অনেকবার পেয়েছিল৷ যতীন বর্ষার দুরন্ত নদী সাঁতারে পারাপার করতেন৷ চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পড়েছেন৷ পথের কলেরা রোগের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ শেষ অব্দি এই বীর যুবক যতীন্দ্রনাথ বাঘ মারার সংকল্প গ্রহণ করায় গ্রামবাসীরা হাফ ছেড়ে বেঁচে ছিল৷ যতীনকে  তারা ত্রাণকর্র্ত বলে মনে করল৷ যতীনের মামাতো ভাইয়ের একটি বন্দুক ছিল৷ মামাতো ভাই বন্দুক নিয়ে যতীনের সঙ্গী হলেন৷ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাঘের  সঙ্গে দেখা হলো৷ মামাতো ভাই বন্দুকের গুলিতে বাঘটাকে বধ করার চেষ্টা করলেন৷ লক্ষ্যভ্রষ্ট হল গুলিটি৷ বাঘটি আহত হল৷ আহত বাঘ  ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, গুলি খেয়ে বাঘটি যতীন্দ্রনাথের দিকে ছুটে এলো৷ যতীন্দ্রনাথ কে আক্রমণ করল?

যতীন্দ্রনাথ কোন বিপদের মুখে পিছপা হননি৷ এবারও পিছপা হলেন না৷ তিনি অসীম বিক্রমে বাঘের গলা চেপে ধরলেন৷ তার মাথার ভোজালি দিয়ে বাঘটিকে বারবার আঘাত করতে লাগলেন৷ বাঘটি যতীনকে কামড়াবার চেষ্টা করলো৷ যতীন্দ্র বাঘটিকে জাপ্ঢে ধরে ভোজালি দিয়ে বার বার মারলেন৷ জড়াজড়ি করে বাঘটিকে ধরে মাটিতে পড়ে গেলেন৷ বাঘ তার দুটি হাঁটুতে কামড় বসালো৷ নখ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করল সমস্ত শরীর৷ রক্তাক্ত যতীন তখনও উন্মত্তের মতো বাঘটার সঙ্গে লড়াই করছেন৷ পশুশক্তি শেষ পর্যন্ত মানুষের শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হল৷ নিজের দেহের আঘাত আগ্রহ করেই হিংস্র ভয়ঙ্কর বাঘটিকে মাটিতে চেপে ধরলেন৷ শেষ অব্দি ভোজালিটা বাঘের পেটে বসিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন৷ সেই আঘাতে বাঘটি শেষ হয়ে গেল৷ আর সেদিন থেকে সকলের কাছে তিনি পরিচিত হলেন বাঘাযতীন হিসেবে৷ বাঘাযতীন শুধুমাত্র বাঘ মেরে জীবন কাটাননি৷ তিনি লড়াই করেছিলেন ব্রিটিশ সিংহের সঙ্গে৷ এই ব্রিটিশ সিংহকে সম্মুখ সমরে হারিয়ে দেবার স্বপ্ণ দেখেছিলেন৷ ১৮৭৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার ছোট্টশান্ত কয়া গ্রামে মামার বাড়িতে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়৷ তার পিতার নাম ছিল উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শরৎশশী দেবী৷ যতীন্দ্রনাথের পৈতৃক বাসস্থান ছিল যশোর জেলা ঝিনাইদহ রিসখালী গ্রামে৷ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হয়৷ ছেলের হাত ধরে  মা এলেন মামার বাড়িতে৷ মামার বাড়িতেই যতীন্দ্রনাথ বড় হয়েছিলেন৷ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির৷ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশে নানা ধরনের দুষ্টুমি করে বেড়াতেন৷ আম বাগান থেকে আম চুরি করতেন৷ পুকুরে মাছ ধরে নিয়ে যেতেন৷ রাতের অন্ধকারে ফল চুরি করতেন৷ গ্রামবাসীরা তার দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছিল৷ মাঝে মধ্যে যতীন্দ্রনাথের মামার কাছে তাঁরা নালিশ করত৷ মামা কিন্তু ভাগ্ণেকে খুবই ভালবাসতেন৷ মামা ছিলেন জাতীয়তাবাদের এক আদর্শ কর্মী৷ মনেপ্রাণে চাইতেন ইংরেজ একদিন এদেশে থেকে দূরে চলে যাবে৷ ভাগ্ণেকে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক কাহানি শোনাতেন৷ তখন থেকেই যতীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন৷ পড়াশোনায় খুব একটা তুখোড় ছিলেন না, তবে মন দিয়ে পড়ার বই পড়তেন৷ পড়াশোনার চেয়ে নানান খেলা শরীরচর্চ প্রভৃতি ছিল তার বেশি উৎসাহ৷ স্কুলে পড়ার সময় একদিন পাগলা ঘোড়াকে কব্জা করে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন৷ কৃষ্ণনগরের এ.ভি. স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এলেন কলকাতায়, কলেজে ভর্তি হলেন৷ কিন্তু তখন থেকেই যতীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ৷ তিনি ঠিক করলেন যে, পড়াশোনায় আর সময় নষ্ট করবেন না৷ শর্টহ্যান্ড ও টাইপ রাইটিং শিখলেন৷ তখনকার দিনে এই দুটি বৃত্তি শিক্ষার খুবই দাম ছিল৷ ১৯০৪ সালে সরকারি চাকরি লাভ করলেন৷ এই চাকরিতে যোগ দেবার আগে থেকেই বিপ্লবী দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল৷ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশাত্মবোধের প্রেরণায় জেগে উঠল সারাদেশ, সেই আবর্তে যতীন্দ্রনাথ ভেসে গেলেন৷ অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করলেন৷ একদিকে অফিসের কাজ, অন্যদিকের সংঘটনের দায়িত্ব৷ তখন যতীন্দ্রনাথকে ব্যস্ত প্রহর কাটাতে হচ্ছে৷ তার ওপর বেশ  কয়েকটি কাজ দেওয়া হয়েছিল, তিনি তরুণ বিপ্লবীদের গীতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতেন৷ তরুণদের কাছে অত্যন্ত  শ্রদ্ধারপাত্র ছিলেন যতীন্দ্রনাথ৷ ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের বোমা নিক্ষেপের পর ইংরেজরা কঠিন-কঠোর আসামিদের দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যাহত করে দেবে৷ তখন বেশিরভাগ জাতীয় নেতা কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন৷

এই সময় এগিয়ে এলেন বাঘাযতীন তিনি ওই সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছিলেন৷ বাঘাযতীন এর বিরুদ্ধে হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হল৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছিল যে,  তিনি ভারত সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ নিয়েছিলেন৷ সরকারি কর্মীকে হত্যা করেছিলেন৷ এই ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বাঘাযতীন শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু সরকারী চাকরী চলে গেল৷ তখন বাঘাযতীন ঠিকাদারি কাজ শুরু করলেন৷ তার গতিবিধির ওপর ব্রিটিশ গুপ্তচররা তীক্ষ্ন নজর রাখত৷ তবে তাকে অনুসরণ করা সম্ভব ছিল না৷ তিনি ৭৫ মাইল সাইকেল চালাতে পারতেন, চলন্ত মেল ট্রেনে ওঠা নামা করতে পারেন৷ অসাধারণ শক্তি ছিল বাঘ যতীনের রূপকথার বিস্ময়কর নায়ক ছিলেন তিনি৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল, বাঘাযতীন গেরিলা লড়াইয়ের  জন্য প্রস্তুত হলেন৷ তিনি সর্বভারতীয় বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে  গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়ে জাপান-জার্মানি থেকে অস্ত্রাদি আমদানি করে সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন৷ ঠিক হয় ‘মেভারিক’ নামক জার্মান জাহাজে অস্ত্র আইনে বালেশ্বর এর রেললাইন অধিকার করে ইংরেজদের যাতায়াত পথ অবরোধ করবেন৷ বাঘাযতীন তার চারজন সহকর্মীকে নিয়ে চলে গেলে বালেশ্বর এর কাছে কোপাতপোদা গ্রামে৷ সন্ন্যাসী সেজে আশ্রম গড়লেন৷ কবে জার্র্মন যুদ্ধজাহাজ পৌঁছাবে তার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর শুরু হল৷ এই জাহাজ শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষ পৌঁছতে পারেননি৷ বিপ্লবীদের  প্রতীক্ষা ব্যর্থ হলো৷ তবুও বাঘাযতীন বিন্দুমাত্র হতাশ হলেন না, তিনি আবার অস্ত্র আমদানির পবিকল্পনা করলেন৷ দ্বিতীয়বারও অস্ত্র পৌঁছলনা৷ বিপ্লবীরা পথেই ধরা পড়ে গেলেন৷ শুরু হলো পুলিশের তল্লাশি৷ পুলিশ জানতে পারল যে বিপ্লবীদের একটা দল বালেশ্বরে লুকিয়ে আছে৷ সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট বালেশ্বরে পৌঁছে গেলেন৷ সেখানে এক সাংকেতিক লিপি পাওয়া গেল৷ ওই লিপিতে বলা হয়েছে রামানন্দ স্বামী যেন তার শিষ্যদের নিয়ে এখনই তীর্থভ্রমণে চলে যান৷ এখানে অনেকেই আশ্রম বাসি হয়েছে৷

গ্রামবাসীদের মুখ থেকে বাঘাযতীন ওই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটা শুনতে পেলেন---বিরাট পুলিশবাহিনী ছুটে আসছে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য৷ বাঘাযতীন তার কিশোর চার সঙ্গী চিত্তপ্রিয়,  মনোরঞ্জন নীরেন ও জ্যোতিষকে বললেন, তার সঙ্গ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে৷ পুলিশরা এদের  কাউকে চেনে না৷  তাই তারা চালাতে পারবেন৷ বিপ্লবী কিশোররা নেতাকে ত্যাগ করতে রাজি হলেন না৷ তারা বললেন, যে আমরা সম্মুখে সমরে  প্রাণ বিসর্জন দেবো তবুও আপনাকে ত্যাগ করবো না৷ বাঘাযতীন সহকর্মীদের এই সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলেন৷ ১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্ঢেম্বর বুড়িবালাম নদীর তীরে চাষখণ্ড নামে একটা জায়গায় বাঘা যতীন তার চার সঙ্গীকে নিয়ে খাদের মধ্যে লুকিয়ে রইলেন৷

একদিকে মাত্র ৫ জন আর অন্যদিকে অসংখ্য সৈন্য৷ এবার শুরু হলো বুড়িবালামের ঐতিহাসিক যুদ্ধ, গুলির জবাবে গুলি৷ তারা ৫ জন একসঙ্গে গুলি করতে শুরু করলো৷ যাতে শত্রু পক্ষ জানতে না পারে তারা ক-জন৷ বেশ কিছু ব্রিটিশ সৈন্য হতাহত হলো৷ শেষ অব্দি বিপ্লবীদের গুলি শেসের দিকে৷ বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলল, ঠিক ওই সময় পুলিশের গুলি এসে আঘাত করলো চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীকে৷ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন  চিত্তপ্রিয়, তখনো যুদ্ধ চলছিল৷ যন্ত্রণা কাতর কন্ঠে তিনি বললেন, বড়দা, আমি চললাম৷

চিত্তপ্রিয় মৃত্যুপথযাত্রী একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করছিল৷ এদিকে বাঘা যতীন গায়েওগুলি লেগেছিল৷ কিন্তু তার শেষ পর্যন্ত লড়াই করার কথা, চিত্তপ্রিয়কে জল খাওয়ানোর জন্য নিজের পরনে রক্তমাখা সাদা শার্ট উড়িয়ে যুদ্ধ বিরতির সংকেত দিলেন ও আত্মসমর্পণ করেন৷ ইংরেজ সাহেব কাছে এলেন, বাঘা যতীন দৃপ্ত কন্ঠে বললেন---শুধু এর মুখে এক ফোঁটা জল দেবার জন্য আমি যুদ্ধ বন্ধ করে ধরা দিচ্ছি৷ কিছুক্ষণ পরেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তরুণ কিশোর চিত্তপ্রিয়৷ আহত বাঘাযতীনকে বালেশ্বর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল৷ পরদিন হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ দিনটি ছিল ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্ঢেম্বর৷ মনোরঞ্জন ও নীরেনকে ফাঁসি দেওয়া হল৷ জ্যোতিষকে যাবজ্জীবন দীপান্তর  দণ্ড দিয়ে পাঠানো হলো আন্দামানে৷ সেখানে তার  ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হলো৷ এই ভয়ঙ্কর অত্যাচারী তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন৷ তখন তাকে বহরমপুর জেলে রাখা হয়৷ বন্দী অবস্থাতেই জ্যোতিষের মৃত্যু হয়৷ এভাবেই শেষ হয়ে গেল বুড়িবালামের লড়াই৷

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন প্রশস্তি রচনা করে ‘‘বাঙালির রন দেখে যারে তোরা রাজপুত, শিখ মারাঠি যাত বালাশোর, বুড়ি-বালামের তীর নব ভারতের হলদিঘাট৷