আজ দুপুরে গোলপার্ক থেকে বাসে করে বেহালায় আমার কর্মস্থলে আসছিলাম।
আসার সময় বাসের ভেতরে আমার মন কেড়ে নেওয়া পর পর দুটে ঘটনা ঘটে গেল !
লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
(1)বাসে কিছু সিট ফাঁকা। বয়স্ক কন্ডাক্টর এদিক ওদিকে ভাড়া নিয়ে টিকিট দিচ্ছিল।
দেশপ্রিয় পার্ক মোড় থেকে নীল জিন্সের প্যান্ট আর গুঁজে সাদা সার্ট পরিহিতা একটি কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে বাসে উঠলো।বাসের পিছন দিকে এগোতে গিয়ে বয়স্ক কন্ডাকটরের পা মাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি "আহা " বলে নীচে ঝুঁকে কন্ডাকটরের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো।তারপর পাশের সীটে গিয়ে বসলো।এমন অপ্রত্যাশিত এবং অকল্পনীয় ঘটনায় বাস কন্ডাকটর থতমত খেয়ে কি করবে বা বলবে বুঝতে না পেরে মেয়েটির দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর নীচু স্বরে বললো,"অনেক বড় হও মা।"
মেয়েটি কন্ডাক্টরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকলো।
দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো আমার।উল্টো দিকের সীটে বসে থাকা আমার মনে হোল, বর্তমান অত্যাধুনিক সময়ে আপাদ মস্তক সাহেবি শিক্ষার ঢেউয়েও আমাদের সনাতন হিন্দু শিক্ষা এবং উপদেশ একদম হারিয়ে যায়নি,এখনও কিছু মানুষের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে।
(2)টালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে বাসটা ডাইনে নিউ আলিপুরের দিকে বাঁক নিয়ে দাঁড়ালো।বাসের ভেতরে সব সীটেই মহিলা পুরুষ বসে। কয়েকজন দাঁড়িয়েও আছে।
দরজার ঠিক উল্টোদিকে লম্বা সীটে তিনটে স্কুল ফেরত ছেলে বসে আছে। সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্র।
সেনাবাহিনীর পোষাক পরা এক জাওয়ান বাসে উঠে পিছনদিকে তাকিয়ে খালি সীট আছে কিনা দেখার চেষ্টা করছিল।বসে থাকা তিনজন স্কুল ফেরত ছেলের মধ্যে একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে জাওয়ানের বাঁ হাতটা ধরে হিন্দি ভাষায় ওর সীটে বসতে বললো।জওয়ানটি কিছুটা আশ্চর্য্য হয়ে ছেলেটির হাতটা ধরে হেসে চোখ নাচিয়ে হিন্দি ভাষাতেই ওকেই বসতে বললো।ছেলেটি এবার হিন্দিতে জাওয়ানকে বললো, "আমার বাবা বলে আপনারা আছেন বলেই তো আমরা এত নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারি। তাই বাসে উঠে সীটে বসার অধিকার আগে আপনার।"জওয়ানের চোখ দুটো খুশীতে চকচক্ করে উঠলো।এত কম বয়সী এক কিশোরের মুখে এমন কথা শুনে জওয়ান বেশ মজা পেল।এবার একহাতে বাসের রড ধরে রেখে আরেক হাতে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হেসে বললো,"তুম বৈঠো। মুঝে আদত হ্যায় খাড়া রহেনেকা।" ছেলেটি বসে পড়লো। সবাই ছেলেটিকে আর জাওয়ানকে দেখছে। আমিও দেখছিলাম। অদ্ভুত একটা মানসিক আনন্দ পাচ্ছিলাম।ভাবছিলাম, এদেশের অতীতের আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের রেখে যাওয়া দেশভক্তি এবং দেশপ্রেম সবার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েনি। শুধুই লোক দেখানো আর মুখে নয়, কিছু মানুষের অন্তরে সত্যিকারের দেশপ্রেম আজও জেগে আছে।মনে হোল,এই কিশোরটি আজ এই মুহূর্তে যেন তার নিজস্বার্থের সীটে দেশপ্রেমকেই বসার জন্য অনুরোধ করলো !
উপরোক্ত দুটো ঘটনায় মেয়ে এবং ছেলেটির মনের শিক্ষা, মানুষ হবার বিদ্যা সম্পূর্ণতার দিকেই এগিয়ে চলেছে। হয়তোবা পূর্ণ হয়েই গেছে।এরা দু'জন আমার ছেলে মেয়ের থেকেও বয়সে ছোট, তবুও এদের প্রাপ্ত শিক্ষাকে সম্মান, শ্রদ্ধা এবং ধন্যবাদ জানাই।
একই সাথে এদের বাড়ির বাবা মা এবং গুরুজনদেরও একই কথা জানাই এবং বাহবা দিই।
এনারাই তো তাদের সন্তানদের শিশু মনের শুরুর নরম কাদামাটির মতো মনের ভেতরে প্রথম থেকে এই শিক্ষা, সংস্কার আর উপদেশের চারাগাছ গুলো পুঁততে শুরু করেছিলেন।
আজ তারই উপকারী ফসল ফলছে।
কারণ, বাড়ির শিক্ষা ভালো না হলে এমন মন ছুঁয়ে যাওয়া সুন্দর মানসিকতা তৈরী হয় না।
এই মেয়েটি এবং ছেলেটি আমার আপনার প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা, উপদেশের সুস্বাদু ফল।
সংগৃহীত
- Log in to post comments