সংস্কৃত আম্র > প্রাকৃতে, আম্ব/অম্বা৷ এর থেকে বাংলায় ‘আঁব’ শব্দটি এসেছে৷ উত্তর ভারতের অধিকাংশ ভাষাতেই এই ‘আম্ব’ বা ‘অম্বা’–জাত ‘আঁব’ শব্দটিই প্রচলিত৷ ওড়িষ্যায় আঁব (আঁব–), মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের অংশবিশেষে আঁবা, গুজরাতীতে অম্বো, মারাঠীতে আম্বা (‘পিকলে আম্বে’ মানে পাকা আঁব), পঞ্জাক্ষীতে আম্ব্ (আম্ব্ দ্য অচার), হিন্দীতে ও বাঙলার কোন কোন অংশে প্রচলিত ‘আম’ শব্দটি থেকেই ‘আঁব’ শব্দটি এসেছে৷ ব্যুৎপত্তিগত বিবর্ত্তনের বিচারে আমের চেয়ে আঁব বেশী শুদ্ধ৷ তবে একটি বিবর্ত্তিত শব্দ হিসেবে আমকেও অশুদ্ধ বলা চলক্ষে না৷ বাঙলার মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, কলিকাতা, ২৪ পরগণা, খুলনা ও যশোরের অংশবিশেষে ‘আঁব’ শব্দই প্রচলিত৷
আঁব ভারতের একটি প্রাচীন ফল যদিও এর আদি নিবাস দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া৷ পৌরাণিক গল্পেও রয়েছে যে হনুমান সমুদ্রপার থেকে এদেশে আঁব এনেছিল৷ তবে আঁব এদেশে এসেছে হাজার হাজার বছর আগে৷ তাই বন্য অবস্থাতেও আমরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আঁবের সন্ধান পাই৷ অবশ্য বন্য আঁবের খোলা একটু মোটা, চোঁচ বা আঁশ একটু বেশী৷ তবে স্বাদ তেমন কিছু খারাপ নয়৷ পাঠান যুগের শেষাশেষি ও মোগল যুগের গোড়ার দিকে ভারতের বিভিন্ন অংশে ব্যাপকভাবে আঁব নিয়ে চর্চা করা হয়েছিল৷ এই আঁবগুলি ভারতের এক এক অংশের এক এক ঘরানার অন্তর্ভুক্ত৷ এই ধরণের ঘরানা বাঙলায় রয়েছে বারুইপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদা, কৃষ্ণনগর, ক্ষারাসাত, বর্দ্ধমান ও হুগলীর দেবানন্দপুর গ্রামে৷
বারুইপুরের সাদা ল্যাঙড়া, কপাটভাঙ্গা, হুগলীর সরিখাস, বিশু চাটুজ্জে, বিশু মুখুজ্জ্যে, শেওড়াফুলির পেয়ারাফুলি, দেবানন্দপুরের লালফুলি, বারাসাত ও কৃষ্ণনগরের গোপালভোগ, মালদার ফজলী, হুগলীর সূর্যপুরী, বর্দ্ধমানের ভুতুবোম্বাই, বেলখাস, সিন্দুরে, মুর্শিদাবাদ ঘরানায় রয়েছে ১১৫ ধরণের আঁব৷ এ ছাড়া ভাগলপুর ঘরানার বিখ্যাত জর্দালু আঁব, মুঙ্গের ঘরানার বড় আকারের ল্যাঙড়া, দ্বারভাঙ্গার কিষেণভোগ (মৈথিলী পণ্ডিত কিষেণপ্রসাদ ঠাকুরের নামে), মুজাফফরপুর–সমস্ ঘরানার সরল ল্যাঙড়া (প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভাল, ল্যাঙড়া আঁবটির জন্ম হাজিপুরে৷ বলা হয়, জনৈক খঞ্জ ফকির এই আঁবটির উদ্ভাবন করেছিলেন৷ তাই একে ল্যাঙড়া অর্থাৎ খোঁড়া আঁব বলা হয়৷ আবার অনেকের মতে ব্যাপারটা তা নয়৷ আঁবটি খোঁড়া এই কারণে যে এই আঁবকে গাছে ঠিকমত পাকানো যায় না৷ আঁবটিকে গাছ থেকে তুলে ঘরে এনে পাকাতে হয়৷ তাই এর নাম ল্যাঙড়া৷ দীঘা ঘরানার সুস্বাদু ল্যাঙড়া, বারাণসী ঘরানার সাদা ল্যাঙড়া, এছাড়া রয়েছে লক্ষ্মৌ–মালিহাবাদের সফেদা, চৌসা, দশেরী আঁব ও গোরক্ষপুর ঘরানার গবাহরজিৎ ও কর্পূরী আঁব এলাহাবাদ ঘরানার মালকা এ ছাড়া রয়েছে সাহারানপুর ঘরানার পঁয়ত্রিশ ধরণের আঁব৷ গুজরাত ঘরানার কেশর আঁবের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত৷ মুম্বাই ঘরানার হাপুস আঁবের খ্যাতি কম নয়৷ পর্ত্তুগীজরা তাঁদের তৎকালীন রাজা এ্যালফ্যান্সোর–নামে এর নামকরণ করেন৷ তেলেঙ্গানা ঘরানার ইমাম পসন্দ্, তোতাপুরী ও বৈগনপল্লী আঁব, তামিল ঘরানার নীলম ও কেরল ঘরানার বার প্রজাতির নামজাদা আঁব রয়েছে৷ চীন দেশের ‘আই–উইন’ আঁবও নামজাদা ভাল আঁব৷ লেখকের স্বর্গত পিতামহ দেওয়ান কুঞ্জবিহারী সরকারও একজন প্রসিদ্ধ আম্রতত্ত্ববিদ ছিলেন৷ তাঁর উদ্ভাবিত ঝিনুক আম ও চীনা–বোম্বাই এককালে ক্ষেশ নাম করেছিল৷ আঁবগুলি তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন বার্মায় থাকাকালে৷ সংস্কৃতে আঁবের পর্যায়বাচক শব্দ হচ্ছে আম্র, রসাল, সহকার, চূত, সুধারস প্রভৃতি৷ ভারত–সম্রাট অওরঙ্গজেব (আলমগীর) আম্ররসিক ছিলেন৷ তিনি তাঁর দাদা দারা শিকোহ্–র মত সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন৷ আঁবের তিনি নাম রেখেছিলেন ‘সুধারস’৷ কাঁচা আঁব কেটে শুকিয়ে রাখলে তাকে বলা হয় আম্র–পেশী–বাঙলায় ‘আমশি’৷ পাকা আঁবের রস রৌদ্রে শুষ্ক্ করা হলে তাকে সংস্কৃতে বলা হয় আম্রসত্ত্ব, আঁবসত্ত্ব বা আমসত্ত্ব৷ বারান্তরে বলা হয়েছে ‘অচার’ (জিনিসটি ‘আচার নয়, ‘অচার’ ‘আচার’ একটি সংস্কৃত শব্দ যার মানে ‘আচরণ’) আমরা করতে শিখেছি পর্ত্তুগীজদের কাছ থেকে৷ শব্দটিও নিয়েছি তাঁদেরই কাছ থেকে৷ তাই প্রাচীনকালে নিশ্চয় আঁবের অচার করতে এ দেশের লোক জানত না৷ তবে পূর্ণতাপ্রাপ্ত কাঁচা আঁবকে নুন তেলের সঙ্গে জারিয়ে বেশী পক্ক করলে আম্রতৈল তৈরী হয়৷ এই আম্রতৈল/আঁবতেল অনেকেই নিশ্চয়ই খেয়েছে৷ মুড়ির সঙ্গে আঁবতেল খেতে মন্দ লাগে না৷ বাঙলার মেয়েরা প্রাচীনকাল থেকেই কাসুন্দি তৈরী করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন সেই সূত্রেই না আমরা বলি–‘‘এসব পুরোণো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী’’৷ পেট ভরে খাবার পরেও কখনও কখনও বলি–‘‘একটু কাসুন্দি অইলে জুত অইত’’৷